শালুক সাহিত্যসন্ধ্যা ২৬
চিন্তার স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপরিচয়ের অন্বেষায় অধুনাবাদ
প্রকাশিত : ১৮:৩০, ৪ জুন ২০২৪
“২০২৪ সালে প্রায় ছয় মাসের মাথায় নতুন করে শুরু হলো শালুকের সাহিত্যসন্ধ্যা। এই আড্ডার জন্য প্রবল আগ্রহ আর কাব্যিক উন্মাদনা সব সময় আমরা অনুভব করি। আপনারা যারা আড্ডায় অংশ নিয়ে আমাদের উৎসাহিত করেন, তারাই আমাদের আড্ডার অন্যতম প্রাণশক্তি। আজকের আড্ডাটিও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর প্রবন্ধ, আলোচনা, বই নিয়ে কথা এবং কবিতা পাঠের ভিতর দিয়েই সমাপ্ত হবে। আজকের আড্ডার বিষয় : “অধুনাবাদের আলোয় এসো নিজেকে খুঁজি”। এটি অধুনবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন‘শালুক’-এর বিভিন্ন উৎসবের স্থায়ী স্লোগান। ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই আজকের মূল প্রবন্ধ লিখেছেন কবি ও নন্দনতাত্তি¡ক মাহফুজ আল-হোসেন।নির্ধারিত বিদগ্ধ আলোচকগণ আলোচনা করবেন মূল প্রবন্ধের উপর। এবং নির্দিষ্ট দুটি বই নিয়ে কথা বলবেন দুজন কবি ও সাহিত্য সমালোচক। সঙ্গে থাকবে নির্বাচিত কবিদের কবিতা পাঠ।” এভাবেই ঢাকাস্থ কাঁটাবন পাঠক সমাবেশে অনুষ্ঠিত ‘শালুক সাহিত্যসন্ধ্যা ২৬’-এর স্বাগত বক্তব্য উপস্থাপন করেন শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ।
পহেলা জুন শনিবার বিকাল পাঁচটা গড়িয়েছে। ততক্ষণে পাঠক সমাবেশের প্রায় প্রতিটি চেয়ার ভরে উঠেছে আগত কবি, লেখক, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ও শুভাকাক্সক্ষীদের উপস্থিতিতে। কবিতার মতো স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশে সঞ্চালক মূল প্রাবন্ধিক মাহফুজ আল-হোসেনের দিকে মাইক বাড়িয়ে দিলেন তাঁর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য। “অধুনাবাদের আলোয় এসো নিজেকে খুঁজি” শিরোনামেরতাঁর ঋদ্ধ প্রবন্ধটির পরতে পরতে চমক আর অধুনাবাদের নতুন নতুন বিষয়ভাবনা উপস্থিত শ্রোতৃকুলে গভীর আগ্রহের সৃষ্টি করে। স্বল্পকথায় লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস থেকে বিকল্প চিন্তার মুখপত্র হিসেবে লিটল ম্যাগাজিনের শক্তিকে তুলে ধরেন তিনি। শালুক এমনই এক অপ্রচল পথ বেছে নিয়েছে নিজেদেরকে সৃষ্টির শক্তিতে বলীয়ান করবার জন্য। এ কারণে শালুকের বড়শিতে আটকে যায় শেকড় অন্বেষী ও সদা সাম্প্রতিক ‘অধুনাবাদ’ নামক চিন্তাপদ্ধতি। প্রাবন্ধিক লিখেছেন, “দর্শন হিসেবে ‘শালুক’ বেছে নিয়েছে স্বসংজ্ঞায়িত ‘অধুনবাদ’কে। এটি ‘অধুনা’ থেকে এসেছে; যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘সাম্প্রতিক’ কিংবা ‘নতুনত্ব’। শব্দগত অর্থের আড়ালে অধুনাবাদের গভীরতর অর্থের অনুসন্ধান অদ্যাবধি চলমান রয়েছে। তদুপরি এর একটা সংজ্ঞার্থ দাঁড় করানো যেতেই পারে: অধুনাবাদ হচ্ছে প্রতিনিয়ত চর্চা ও জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে চিন্তার পুনঃনবায়নের একটি প্রক্রিয়া। এই পুনঃনবায়নের মধ্যে মূলে ফেরার একটা অভীপ্সা রয়েছে। সে কারণে অধুনাবাদ একটি শেকড়-অন্বেষী ধারণাও বটে। মূল খোঁজ করার ব্যাপারটি কালে কালে সৃষ্টিশীল মানুষের অন্যতম নৃতাত্ত্বিক -সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য।” একই সঙ্গে তিনি সদা সাম্প্রতিক ও শেকড় অন্বেষী কয়েকজন আত্মপ্রত্যয়ী কবির কবিতার উদ্ধৃতি ব্যবহার করে প্রমাণ করেন অধুনাবাদের যাথার্থতা।প্রবন্ধের ওপর আলোচক প্যানেলে ছিলেন। কবি জিললুর রহমান, প্রাবন্ধিক সরকার আবদুল মান্নান, কবি ওবায়েদ আকাশ, কবি জুনান নাশিত, কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া (উপস্থিত থাকতে পারেননি), কথাসাহিত্যিক মিলন কিবরিয়া, প্রাবন্ধিক স্বপন নাথ, কবি জাফর সাদেক ও কবি তরুন ইউসুফ। ‘বই নিয়ে কথা’ পর্বে ছিলেন কবি বিনয় বর্মন ও কবি আশরাফুল কবীর।
সভ্যতা ও প্রকৃতি আজ ধ্বংসের পথে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এ থেকে পরিত্রাণের পথ দুরূহ। নগর সভ্যতার আগ্রাসী রাতে কেড়ে নিচ্ছে আমাদের নৈসর্গিক পরিবেশ। অধুনাবাদ এসব ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করে চলেছে। মূল প্রবন্ধকে ঘিরে আলোচক তরুন ইউসুফ বলেন, “শব্দগত অর্থে অধুনাবাদের অর্থ সাম্প্রতিক বা নতুনত্ব হলেও প্রবন্ধকার জানিয়েছেন অধুনাবাদ মূলত চিন্তার পুনঃনবায়নের মধ্য দিয়ে মূলে ফেরার ইচ্ছা এবং অধুনাবাদের মূল দর্শন মূলত এখানেই। আমরা যখন অধুনাবাদ নিয়ে কথা বলছি তখন অর্থনৈতিকভাবে পুঁজিবাদী এই বিশ্বব্যবস্থা রাজনৈতিকভাবে ডানপন্থাতথা কর্তৃত্ববাদীদের হাতে চলে যাচ্ছে। পৃথিবীতে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে এবং প্রকৃতি ধ্বংসের কারণে মানুষের সভ্যতার অহংকার তথা অস্তিত্বহুমকির সম্মুখিন। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্ন চিন্তা মানুষকে একত্রিত করার বদলে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করছে। মানুষের অবস্থান সামগ্রিক না হয়ে ব্যক্তি সর্বস্ব। সেই সময়ে এসে শালুক গোষ্ঠীর এই মূলে ফেরার যে আকুতি তা নিশ্চিতভাবেই আশার সঞ্চার করে এবং আমরা সহযাত্রী হিসেবে শালুকের এই আত্মঅনুসন্ধানের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পারি।”
শালুকের দেশি-বিদেশি লেখকদের নিয়ে বিশেষ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়ার পিছনে শালুক পরিবারের রয়েছে অসামান্য কিছু কাজ। শালুক আজ পঁচিশ বছর অতিক্রম করেছে এবং স্বউদ্ভাবিত অধুনাবাদ কিংবা চিন্তার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কাজ করছেন যা আমাদেরকে আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে আহ্বান করে। আলোচক জাফর সাদেক বলেন, “শালুক প্রবর্তিত অধুনাবাদ যে ইউরোপীয় রেঁনেসা অর্থাৎ সুররিয়ালিজম বা পোস্ট-মডার্নিজমের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, তার প্রমাণ পাই শালুকের পরিবর্তনের ধারা, ব্যাপ্তি ও ভিন্নতায় বিগত পঁচিশ বছরের প্রকাশনা দেখে। সুররিয়ালিজ বামডার্নিজম ছিলো সময়নির্দিষ্ট ইজম, কিন্তু শালুক প্রবর্তিত অধুনাবাদ তা নয়। জীবন কিংবা পৃথিবী পরিবর্তনশীল। এখানে রবার্ট ফ্রস্টের একটি উক্তিপ্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, সেই যথার্থ মানুষ, যে জীবনের পরিবর্তন দেখেছে এবং পরিবর্তনের সাথে নিজেও পরিবর্তিত হয়েছে। সেই পরিবর্তনের ধারায় আমরা লক্ষ্য করি, শালুক সম্পাদক যেমন বিদেশি সাহিত্যিকদের তুলে ধরেছেন তেমনি বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখকদের উপরবিস্ময়কর সব সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। উদাহরণ হিসাবে লোরকা বা মার্কেস সংখ্যা কিংবা শঙ্খ ঘোষ ও সিকদার আমিনুল হক সংখ্যার মতো আরো কিছু সংখ্যার উল্লেখ করা যায়। এই পরিবর্তনের ব্যাপ্তি স্বকীয়তায় ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সফলভাবে বিকশিত করাই অধুনাবাদ। এবং সেই কারণেই শালুক এখনওলিটল ম্যাগাজিনের জগতে অনন্য নক্ষত্রস্বরূপ।”
মূল প্রবন্ধের উপর আলোচক ছিলেন প্রাবন্ধিক স্বপন নাথ। অধুনাবাদের চিন্তার পুনঃনবায়ন ও সাংস্কৃতিক শেকড়ের অন্বেষাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেতিনি বলেন, “একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রবন্ধে কবি-প্রাবন্ধিক-নন্দনতত্ত¡বিদ মাহফুজ আল-হোসেন চমৎকার ভাষা ও চিন্তাশীলতার নৈপুণ্যে একটি বিশাল পরিসরের বিষয়কে ফুটিয়ে তুলেছেন। যা অনবদ্য এবং প্রশংসার দাবিদার। ‘অধুনাবাদ’কে সংজ্ঞায়িত করতে তিনি সুচিন্তিতভাবে যে শব্দ ও বাক্যগুলো ব্যবহার করেছেন, সেখানে তিনি চিন্তার পুনঃনবায়ন, শেকড় অন্বেষণ এবং চলমানতার কথা বলেছেন যার প্রত্যেকটিই বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। তবে তিনি যে চিন্তার পুনঃনবায়নের কথা বলেছেন, তার জন্য লেখক-কবি-চিন্তাশীলদের ভাবনা বিনিময় একটি অপরিহার্য পন্থা হতে পারে, যার কেন্দ্র হতে পারে শালুক-এর সাহিত্য আড্ডা। আর শেকড় অন্বেষী হতে হলে প্রাবন্ধিক যেভাবে বলেছেন, নিজেকেই আগে জানতে হবে, নিজের সাহিত্য সংস্কৃতির শেকড়কে জানতে হবে। এ প্রসঙ্গে ফ্রানৎস কাফকাকে উদ্ধৃত করে বলা যায়। “আমি একটি খাঁচা, একটি পাখির খোঁজে। অনেক বই আছে যা নিজের প্রাসাদে অজানা প্রকোষ্ঠের চাবির মতো।” বর্তমান সময়ের সাহিত্যে আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতা কোনটিই সময়ের সম্পূর্ণ দাবি মেটাতে পারছে না বিধায় চলমানতায় ভর করতে হবে, আর সামনে চলার নিমিত্ত পেছনেও তাকাতে হবে উৎস এবং প্রেরণার খোঁজে।”
আলোচক কথাসাহিত্যিক মিলন কিবরিয়া প্রবন্ধের উপর আলোচনা করতে গিয়ে কিছু মৌলিক বিষয়ের অবতারনা করেন। তিনি বলেন, “অধুনবাদ কোনো ইজম নয় মনে করা হলেও, এর একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকার প্রয়োজন আছে। এটির একটি ইশতেহার প্রয়োজন। অধুনাবাদ একটা সাহিত্যিক দর্শন, এটা মানতে হবে। আমরা চাই অধুনাবাদের একটি সুনির্দিষ্ট দার্শনিক ব্যাখ্যা। অধুনাবাদ একটি সাহিত্যতত্ত্ব এবং সাহিত্যচর্চার চিন্তাকাঠামো। যথাযথভাবে এটার সুফল পেতে হলে এটিকে দাঁড় করানোর জন্য যা যা প্রয়োজন সে প্রয়োজনগুলিকে আমলে নিতে হবে।”
শালুক চিন্তাশীলতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন যা অধুনাবাদে নিহিত সত্য। সুচিন্তিত প্রবন্ধের উপর আলোচনা করতে গিয়ে কবি জুনান নাশিত বলেন, “মানুষ চিন্তাশীল প্রাণি।চিন্তাশীলতা আছে বলেই মানুষ সভ্যতা নির্মাণ করতে পেরেছে। তেলাপোকা, প্রজাপতি, পিঁপড়া কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে আছে। তারা কিন্তু পৃথিবী বদলাতে পারেনি। এমনকি নিজেদেরকেও না। মানুষ পেরেছে। কারণ মানুষের ভাষা আছে, চিন্তাশীলতা আছে, জ্ঞান ও যুক্তি আছে। বিশ্ব আজ টালমাটাল। কেন টালমাটাল? আমরা কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি এসব নিয়ে ভাবনা প্রয়োজন। প্রয়োজন চিন্তা করা। লিটলম্যাগ শালুক অধুনাবাদের একটি ধারণার মধ্যদিয়ে সে চিন্তার জায়গাটাকেই স্পর্শ করতে চাইছে। উস্কে দিতে চাইছেন যা খুবই তাৎপর্যময় ও ভালো উদ্যোগ বলে আমি মনে করি। এ প্রসঙ্গে আমি বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের কথা স্মরণ করছি। আবুল হুসেন ১৯২৬ সালে এ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তাদের স্লোগান ছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। মানুষই পারে জ্ঞান ও যুক্তির সম্মিলনে মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে। পৃথিবীতে অনেক সভ্যতা ছিল। সেসব নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রিক সভ্যতার যুক্তি ও জ্ঞান নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব আজও বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। তাই জ্ঞান ও যুক্তিকে অস্বীকার করে মানুষ বেশিদূর যেতে পারে না। সে গন্তব্যহীন হয়ে পড়ে। শালুক চিন্তাশীলতার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে যে প্রচেষ্টা শুরু করেছে তাকে আমি সাধুবাদ ও স্বাগত জানাই। এ খুবই দরকারি উদ্যোগ। এটি অব্যাহত রাখাও জরুরি। প্রাবন্ধিক মাহফুজ আল-হোসেন তার সুচিন্তিত প্রবন্ধে অধুনাবাদের বিষয়টি অল্প কথায় আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। তিনি বিষয়টি ভালোভাবেই স্পষ্ট করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। অধুনাবাদকে তত্ত্ব হিসেবে নয়, আপাতত একটি কনসেপ্ট হিসেবেই শালুক দাঁড় করাতে চাচ্ছে। পরে আরো তর্ক বির্তকের মধ্যদিয়ে এটির একটি ব্যাপক ও সামগ্রিক চিত্র আমাদের কাছে শালুক তুলে ধরতে পারবে বলে আমি মনে করি। কারণ শালুক একটি প্রিন্টেট ভার্সনও বটে। এর মাধ্যমে আমরা অধুনাবাদের একটা স্থিরচিত্রও পেয়ে যাবো। শালুক তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে এই আশা ব্যক্ত করছি।”
মূল প্রবন্ধের উপর বক্তা ছিলেন কবি জিললুর রহমান। তিনি অধুনাবাদকে রাজনীতির মধ্যে রেখেই বিবেচনা করতে চান। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, “কোন মতবাদ বা দর্শনই রাজনীতির বাইরে নয়। দীর্ঘকাল মানব সমাজের সব দর্শন ছিল ডগমা-তাড়িত। সবাই মনে করতো তার ধারণাই সত্য, অন্য সব মিথ্যা। অধিকাংশ মানুষ এখনও এমনটাই ভাবে। সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদ, পুঁজিবাদ থেকে মার্কসবাদ, সকল মতবাদের অনুসারীরাই ডগমাতাড়িত। তবে আধুনিকতাবাদ যুক্তিকে গুরুত্ব দেয়, যা ধর্মান্তর থেকে মানুষকে মুক্ত করার প্রয়াস পায়। কিন্তু হিটলার যুক্তি দেখিয়ে মানুষ মারার কারণে জন্ম নেয় যুক্তির অসারতার চিন্তা যা একইসাথে ডগমারও বিপরীতে অবস্থান নেয় এবং পোস্টমডার্ন বলে খ্যাতিলাভ করে। সমসময়ে বাংলায় উত্তর আধুনিকতা এবং পরবর্তীকালে উত্তর চেতনার চর্চাও সূচিত হয়। ডগমা ও কেন্দ্র ভেঙে শতপুষ্প প্রস্ফুটিত হবার বাসনায় এসব চিন্তা ছড়িয়ে পড়ে। এমন সময়ে লিটল ম্যাগাজিন শালুক তাদের চিন্তাচর্চার পদ্ধতিকে ‘অধুনাবাদ’ নামে চিহ্নিত করে। ক্রমাগত আত্ম-অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে সময়ের সাথে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করে, যা অন্য মতের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়ে সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। এ বিষয়ে সুচিন্তিত প্রস্তাব সূচিত করে যে নিবন্ধে কবি মাহফুজ আল-হোসেন প্রস্তাব করেন, “অধুনাবাদের আলোয় এসো নিজেকে খুঁজি” সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুলিখিত। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে নিয়মিতভাবে কবি ওবায়েদ আকাশের সম্পাদনায় এই শেকড় নিবিষ্ট সময়কে ধারণ করে এগিয়ে যাবার ধারণা অধুনাবাদসহ মানবতাকে সমুন্নত করার সকল ধারণা নানা মাত্রিকতায় সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, এটাই কামনা করি।”
অধুনবাদের আলোয় এসো নিজেকে খুঁজি। এতটা খোঁজাখুঁজির পর আমরা আসলে কী পেলাম, সে বিষয়ে কিছুটা ধারণা দিলেন প্রাবন্ধিক সরকার আবদুল মান্নান। তাঁর স্পষ্টবক্তব্যে বলেন, “চর্যাপদের কবি লুই পা সময়ের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের মধ্যে যদি সময়প্রবেশ করে, তাহলে তার চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। সুতরাং তারা সময়কে অতিক্রম করে জীবন অতিবাহিত করতে চেয়েছেন। আমার মনে হয়, সময়-সংবেদনা যাপিত জীবনের অনিবার্য নিয়তি। এই নিয়তিকে ধারণ করতে চায় অধুনাবাদের প্রবক্তা শালুকগোষ্ঠী। সমকালের সময় সংবেদনা যাদেরলেখার মধ্যে তাৎপর্যময়ভাবে উপস্থাপিত হয়, অধুনাবাদ তাদেরই পরিতোষক। অধুনাবাদী গোষ্ঠী চায়, লেখকগণ, চিন্তকগণ সময়কে ধারণ করুক। সময়ের ভেতরে প্রতিনিয়ত যে রক্তাক্ত অধ্যায় সূচিত হয়ে যাচ্ছে, তার চিহ্নসকল লেখক ও চিন্তকদের ভাবনায় উপস্থাপিত হোক। আর এই উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে সমকাল তার আপন স্বরূপে বাক্সময় হয়ে উঠতে পারে। আমার মনে হয়, অধুনাবদী ভাবনা সময়ের এই পটভূমিতে দানা বেঁধে উঠেছে।”
প্রবন্ধকেন্দ্রিক আলোচনায় কবি ওবায়েদ আকাশ বলেন, “যা কিছু ভাল এবং কল্যাণকর অধুনাবাদ তা গ্রহণ করবে। যে কারণে অতীতের কোনো ইজম বা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি বিরোধী বা সাংঘর্ষিক নয় অধুনাবাদ। আবার যারা মডার্নিজম এবং পোস্ট মডার্নিজমের সঙ্গে অধুনাবাদকে মিলিয়ে ফেলেন, তাদের জন্য বলি, মডার্ন কিংবা পোস্ট মডার্নের বাংলা ‘অধুনা’ নয়। অধুনাবাদ সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানায় সিক্ত। একটি উড়ন্ত চিন্তাপদ্ধতি। যাকে গ্রহণ করে সারা বিশ্বই অধুনাবাদী বিশ্ব হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। অধুনাবাদ পশ্চিম থেকে ধার করা কোনো তত্ত্ব বা ইজম নয়, আমরা আমাদের স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যের অহঙ্কারকে বিশ্ব পরিসরে পৌঁছে দিতে চাই। কিংবা বিশ্ব তা গ্রহণ করে ঋদ্ধ হতে পারে। বাংলা কবিতা কিংবা সাহিত্য ততটাই অতল কিংবা নীলিমা স্পর্শ করুক, যাতে একটি কবিতা বা গদ্য একবার পাঠ করেই বোঝা যায় এটি বাংলা কবিতা কিংবা সাহিত্য। অর্থাৎ আমাদের রচিত সাহিত্যের প্রাণপিঞ্জরে যেন বাংলা কিংবা বাঙালিত্বের গুনগুন শোনা যায়।”
সম্মানিত আলোচকগণের বক্তব্যে এটা উঠে আসে যে, ইতোপূর্বে বাংলাদেশে কোনো সাহিত্যিক চিন্তা কাঠামো বা ভাবনা পদ্ধতি নিয়ে এতটা বৃহৎ পরিসরে কোনো আলোচনা হয়নি। শালুক চিন্তার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এসময়ে অধুনাবাদের প্রাসঙ্গিকতাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। অধুনাবাদ একটি সর্বসাম্প্রতিক চিন্তার আধার। অতীতকে ছুঁয়ে অনন্তে পা বাড়াবার পদ্ধতি হলো অধুনাবাদ।
এর পর অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মাহফুজ আল-হোসেনের “Theory of Love Maximisation” বইটি নিয়ে আলোচনা করেন কবি আশরাফুল কবীর। তিনি গ্রন্থের কবিতাগুলোর অনন্য শক্তিমত্তায় বিস্মিত হন। সময় স্বল্পতার কারণে সঞ্চালক তাকে বারবার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করতে বলেন। তবে তিনি কবি মাহফুজ আল-হোসেনের কবিতার বইটিকে একটি অনন্য কাব্যগ্রন্থ বলে ব্যাখ্যা দেন। তিনি কবির কয়েকটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে এমন ইংরেজি কবিতা লিখিত হচ্ছে না খুব একটা। এধরনের কবিতার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
কবি বিনয় বর্মন আলোচনা করেন ওবায়েদ আকাশের “কবিতাসংগ্রহ ১” বইটি নিয়ে। এই সংগ্রহে কবির প্রথম দিকের মোট বারোটি গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। আলোচক বলেন, আমি ওবায়েদ আকাশের ৫০০ কবিতা পড়েছি এবং ২০ পৃষ্ঠার নোট নিয়েছি। তার প্রেক্ষিতেবলি, আমি মনে করি ওবায়েদ আকাশ এ সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। গ্রন্থে তার একটি কবিতাও ঝুলে পড়েনি। তাঁর কবিতা একদমই কমপ্যাক্ট। তিনি বিশুদ্ধ নান্দনিকতার কবিতা লিখেছেন। কলাকৈবল্যবাদিতায় তিনি আস্থাশীল সত্য, তবে তার কবিতা থেকে বাদ পড়েনি রাজনীতি, প্রান্তিক মানুষের সুখদুঃখসহ বিচিত্র প্রসঙ্গ। কবিকে তিনি অত্যন্ত সচেতন কবি হিসেবে আখ্যা দেন। কবির বিস্ময়কর কিছু কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরে বিনয় বর্মন তার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করেন।
‘বই নিয়ে কথা’ পর্বের আগে থেকেই কবিতা শোনানোর ব্যাপারটা ঘটেই চলছিল আড্ডায় বৈচিত্র্য আনতে। কবিতাপাঠ পর্বে দুএকজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশের কবিতা স্পর্শ করে কবিতাপিয়াসী হৃদয়। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানের কবিতাও যে তাঁর কথাসাহিত্যের মতোই জাদুকরী, তার কবিতাপাঠে তা প্রমাণিত হয়। তরুণ কবি ডালিয়া চৌধুরী, রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা, সঞ্জয় দেওয়ান প্রথম এসেও তাদের কবিতার চমক দেখান। আরও কবিতা শোনান কবি হাইকেল হাশমী, শাকিব লোহানী, আবদুর রাজ্জাক, মুশাররাত, আহমেদ ফরিদ, আবদুল্লাহ জামিল, মতিন রায়হান, কবীর হোসেন, ফারুক আফিনদী, অদ্বৈত মারুত, পারভেজ আহসান, মাহবুবা ফারুক, মনজুর শামস, শেলী সেনগুপ্তা, মাশরুরা লাকী, কামাল মোস্তফা, মাহফুজ আল-হোসেনসহ আরো অনেকে। কবিতা শোনার জন্য সকলে অপেক্ষা করেন রাত নয়টা অবধি।
সবশেষে শালুক সম্পাদকের সমাপনী বক্তব্য ও আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ চার ঘণ্টার মুখরতাপূর্ণ আড্ডাটির পর্দা নামে। জয়তু শালুক, জয় অধুনাবাদ।