ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪

চিরসবুজ দেব আনন্দ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৪৪, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ২০:২২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

অভিনেতা দেব আনন্দ।

অভিনেতা দেব আনন্দ।

হিন্দি সিনেমায় রাজ করেছেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। তাকে বলা হয়, বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সফল ও জনপ্রিয় অভিনেতা। প্রায় সত্তর বছর তিনি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি হলেন বিখ্যাত অভিনেতা দেব আনন্দ। রাজ কাপুর, দিলীপ কুমারদের পাশাপাশি তার নামটিও উচ্চারিত হয় হিন্দি সিনেমার ইতিহাসের পাতায়।

১৯২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের শাকারগড়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন দেব।। বর্তমানে যা পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অন্তর্ভূক্ত। দেব আনন্দের পুরো নাম ধর্মদেব পিসোরিমল আনন্দ। তার বাবা পিসোরি লাল আনন্দ ছিলেন একজন খ্যাতনামা অ্যাডভোকেট।

এ প্রজন্মের খুব বেশি মানুষ হয়ত তাকে চেনেন না। কিন্তু সিনেমার স্বর্ণালী ইতিহাসের সঙ্গে যাদের অল্প-বিস্তর যোগাযোগ আছে, তাদের কাছে দেব আনন্দ এক অবিস্মরণীয় নক্ষত্র। সব সময় পরিপাটি থাকা একজন অভিনেতা হিসেবে দারুণ সুনাম রয়েছে দেব আনন্দের। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘চিরসবুজ এক রোমান্টিক তারকা’।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি তিনি। পেয়েছেন ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব। এছাড়াও তাকে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার দেওয়া হয়। এসবের পাশাপাশি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, আইফাসহ ভারতের বড় বড় সম্মাননা তার ঘরের শেলফে থরে থরে সাজানো।

কিংবদন্তি এ অভিনেতা ‘হাম এক হ্যায়’ ছবির মাধ্যমে ১৯৪৬ সালে তার অভিনয় জীবন শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ‘জিদ্দি’ ছবি মুক্তি লাভের পর তিনি সুপারস্টার খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অভিনয় জীবনে তার প্রাপ্তি ছিল অনেক।

একাধারে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ অভিনেতা, সফল পরিচালক ও দক্ষ প্রযোজক। অভিনেতা হিসেবে তার ঝুলিতে জমা রয়েছে শতাধিক ছবি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বার্ধক্য তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

দেব আনন্দ পড়াশোনার সূচনা করেছেন স্যাক্রেড হার্ট স্কুলে। এরপর তিনি লাহোর সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজিতে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে দেব আনন্দ পাড়ি জমান বোম্বে। কিন্তু গিয়েই অভিনয়ের সুযোগ পাননি। তার প্রথম চাকরি ছিল মিলিটারিতে। মাসে ৬৫ রুপি বেতনে তিনি চাকরি করতেন তখন। এরপর তিনি একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে সামান্য ক্লার্কের চাকরিও করেছেন।

পরবর্তীতে দেব আনন্দ তার বড় ভাই চেতন আনন্দের সঙ্গে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেন। সেখানে যাতায়াতের মাধ্যমে অশোক কুমারের অভিনয় দেখে অনুপ্রাণিত হন দেব আনন্দ। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই অভিনয়ের কথা মাথায় আসে তার।

১৯৪৬ সালে দেব আনন্দকে কাজের প্রস্তাব দেয় প্রভাত ফিল্মস। সিনেমার নাম ‘হাম এক হ্যায়’। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির গল্পে নির্মিত সিনেমায় দেব আনন্দের অভিনয় প্রশংসিত হয়। এই সিনেমায় শুটিং করতে গিয়ে অভিনেতা ও নির্মাতা গুরু দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সে সময় তারা একটি বিষয়ে সম্মত হন যে, তাদের দু’জনের মধ্যে যে-ই সফল হোক না কেন, পরবর্তীতে অপরজনকে সহযোগিতা করবে। পরবর্তীতে দেখা যায় যে, দেব আনন্দ কোনো সিনেমা প্রযোজনা করলে সেটা নির্মাণ করেছেন গুরু দত্ত; আবার গুরু দত্ত অন্য কোনো হাউজের সিনেমা নির্মাণ করলে সেখানে অভিনয় করেছেন দেব আনন্দ।

দেব আনন্দে ক্যারিয়ারে প্রবেশের আগেই তার অমর প্রেমগাঁথা নিয়ে আলোকপাত করা জরুরি। কেননা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই তিনি গভীর প্রেমে জড়িয়েছিলেন। চল্লিশের দশকের শেষ ভাগে দেব আনন্দ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেন, যেগুলো ছিল মূলত নারীকেন্দ্রিক। আর সেই নারী চরিত্রে ছিলেন সুরাইয়া। একসঙ্গে কয়েকটি সিনেমায় কাজ করে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

দেব ও সুরাইয়া জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন সাতটি সিনেমায়। এগুলো হচ্ছে- ‘বিদ্যা’, ‘জিত’, ‘শায়ের’, ‘আফসার’, ‘নিলি’, ‘দো সিতারে’ ও ‘সানাম’। প্রতিটি সিনেমাই ছিল বক্স অফিসে সফল। কিন্তু তাদের অভিনীত সিনেমা যতই সফল হোক না কেন, তাদের প্রেম আর সফল হয়নি। তাদের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। ‘আফসার’ সিনেমার শুটিং সেটে ৩ হাজার রুপির একটি আংটি দিয়ে সুরাইয়াকে প্রস্তাব দেন দেব। কিন্তু সুরাইয়ার দাদি এই প্রস্তাব মানতে নিষেধ করেন। যদিও মনে মনে দেব আনন্দের প্রতি ভীষণ দুর্বল ছিলেন সুরাইয়া। কিন্তু পরিবারের অমতে তিনি প্রেমিকের দিকে এগোতে পারেননি।

দেব আনন্দের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের পর কয়েক বছর কাজ করেছেন সুরাইয়া। কিন্তু বেশি দিন আর নিয়মিত থাকেননি। ১৯৬৩ সালের পর আর কোনো সিনেমায় দেখা যায়নি সুরাইয়াকে। শুধু তাই নয়, গোটা জীবনে তিনি আর বিয়েই করেননি! আর দেব আনন্দ বিয়ে করলেও সংসার জীবনে সুখী হতে পারেননি। কারণ সারা জীবন মনের ভেতরে পুষে রেখেছেন সেই সুরাইয়াকেই।

এবার ফেরা যাক দেব আনন্দের ক্যারিয়ারে। সুরাইয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দেবের ক্যারিয়ার আরও ঝলমলে হয়ে উঠলো। একের পর এক সুপারহিট সিনেমা আসতে থাকলো তার ঝুলিতে। তিনি হয়ে উঠলেন হিন্দি সিনেমার শীর্ষ জনপ্রিয় নায়ক।

১৯৪৯ সালে দেব আনন্দ তার ভাই চেতন আনন্দের সঙ্গে গড়ে তোলেন নবকেতন ফিল্মস নামের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বহু সিনেমা প্রযোজনা করেছেন। এখান থেকে প্রযোজিত দ্বিতীয় সিনেমা ছিল ‘বাজি’। এটি নির্মাণ করেন গুরু দত্ত। ক্রাইম-থ্রিলার ধাঁচের সিনেমাটিতে দেবের সঙ্গে অভিনয় করেন কল্পনা কার্তিক। পরবর্তীতে যিনি দেব আনন্দের স্ত্রী হয়েছিলেন। এই সিনেমা বলিউড সিনেমার জন্য একটি বড় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। বলা হয়ে থাকে, ক্রাইম-থ্রিলার ঘরানার সিনেমার প্রচলন ‘বাজি’র মাধ্যমেই হয়েছে।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেব আনন্দ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘তেরে ঘর কে সামনে’, ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণ’, ‘গাইড’, ‘কালা পানি’, ‘পেয়িং গেস্ট’, ‘জুয়েল থিফ’, ‘হাম দোনো’, ‘প্রেম পূজারী’, ‘জনি মেরা নাম’, ‘তিন দেবিয়া’, ‘আসলি-নাকলি’, ‘বোম্বাই কা বাবু’, ‘সি আই ডি’, ‘বাজি’, ‘কালা বাজার’, ‘তেরে মেরে সাপনে’, ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘সোলভা সাল’, ‘গেম্বলার’, ‘ন দো গেয়ারা’, ‘জাল’, ‘জালি নোট’, ‘হাউজ ন.৪৪’, ‘মহল’, ‘মানজিল’, ‘রাহি’, ‘মুনিমজি’, ‘লাভ ম্যারেজ’, ‘সানাম’, ‘জিদ্দি’, ‘শরীফ বদমাশ’ ও ‘আওয়াল নাম্বার’ ইত্যাদি।

চলচ্চিত্র জীবনের বাইরে দেব আনন্দ রাজনীতিতেও ছিলেন সরব। সত্তরের দশকে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। সে সময় তিনি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষদের নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করে তিনি আন্দোলন করেছিলেন। এমনকি ন্যাশনাল পার্টি অব ইন্ডিয়া নামে একটি দলও গঠন করেছিলেন দেব। যদিও সেটা পরবর্তীতে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

ব্যক্তিগত জীবনে দেব আনন্দ বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী কল্পনা কার্তিককে। ১৯৫৪ সালে তাদের বিয়ে হয়। এই দম্পতির দুই সন্তান রয়েছে। তাদের নাম সুনিল আনন্দ ও দেবিনা আনন্দ।

২০১১ সালের ৩ ডিসেম্বর দেব আনন্দ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করার জন্য তিনি গিয়েছিলেন লন্ডনে। সেখানকার দ্য ওয়াশিংটন মেফেয়ার হোটেলে অবস্থানকালীণ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। ওই বছরই মুক্তি পেয়েছিল তার অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা ‘চার্জশিট’।

এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি