চোখের চাপ, গ্লোকমা রোগ এবং প্রতিকার (ভিডিও)
প্রকাশিত : ১৬:২১, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৬:০৯, ৪ জানুয়ারি ২০১৮
গ্লোকমা এমনই একটি অসুখ যে অসুখে চোখের অপটিক স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়; এর সঙ্গে চোখের অভ্যন্তরীণ চাপের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের চোখের সঙ্গে মস্তিষ্কের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। প্রায় ১২ লাখ জীবন্ত তার দিয়ে অপটিক স্নায়ু গঠিত। সুস্থ স্বাভাবিক দৃষ্টির জন্য সুস্থ অপটিক স্নায়ু প্রয়োজন। গ্লোকমা রোগটি মূলত এ অপটিক স্নায়ুকেই আক্রান্ত করে।
চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধির কারণে যেসব সূক্ষ্ম রক্তনালিকা অপটিক স্নায়ুকে পুষ্টি যোগায় সেগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অপটিক স্নায়ু ধীরে ধীরে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে, দৃষ্টির পরিধি বা পরিসীমা সংকুচিত হতে থাকে। একপর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি লোপ পায় এবং একজন মানুষ অন্ধত্ব বরণ করে। এটিই হচ্ছে গ্লোকমা রোগ।
একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) ‘দি ডক্টরস্’ অনুষ্ঠানে ‘চোখের চাপ, গ্লোকমা রোগ এবং প্রতিকার’ বিষয়ে কথা বলেছেন গ্লোকমা বিশেষজ্ঞ- ডা. হারুন উর রশিদ। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন- অধ্যাপক ডা. ইকবাল হাসান মাহমুদ।
প্রশ্ন : চোখের চাপ বলতে আমরা আসলে কি বুঝি?
উত্তর : আমরা সকলে রক্ত চাপের কথা জানি। কিন্তু চোখেরও একটা চাপ রয়েছে। আমাদের চোখের ভেতরে ‘একোয়াস হিউমার’ নামের এক ধরণের জলীয় পদার্থ রয়েছে। সেই জলীয় পদার্থ আমাদের চোখের ভেতর একটা চাপের সৃষ্টি করে। এটি হলো চোখের অভ্যান্তরিণ চাপ। চোখের চাপ সাধারণত ১০ থেকে ২১ মিলিমিটার অব মার্কারি বা পারদ স্তম্ভের ভেতরেই থাকে। এখানে বলে রাখা ভালো একটি সুস্থ চোখের জন্য, চোখের অভ্যান্তরিণ চাপ স্বাভাবিক মাত্রার ভেতরে থাকা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : গ্লোকমা রোগটা আসলে কি?
উত্তর : গ্লোকমা একটি ভয়ঙ্কর রোগ। এটা এতোটাই ভয়াবহ যে আমাদের চোখেল অপটিক স্নায়ু, খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার সাথে চোখের অভ্যান্তরিণ চাপের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ চোখের এই অভ্যান্তরিণ চাপ কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
প্রথমে বলেনি অপটিক স্নায়ু জিনিসটা আসলে কি?
আসলে আমাদের চোখের সমস্ত তথ্য মস্তিষ্কে যায় প্রায় ১২ লক্ষ জীবন্ত তার দিয়ে। সম্মিলিত ভাবে যাকে আমরা অপটিক স্নায়ু বা অপটিক নার্ভ বলি। এটাকে আমরা ফাইভার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে তুলোনা করতে পারি। গ্লোকমা এই অপটিক স্নায়ুকে আক্রান্ত করে। এর ফলে আমাদের দৃষ্টির পরিসিমা সংকুচিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে দৃষ্টি শক্তি লোপ পায়। অন্ধত্ব বরণ করে।
প্রশ্ন : কাদের এই গ্লোকমা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে?
উত্তর : এটা খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। আসলে গ্লোকমা যে কোন মানুষের, যে কোন বয়সের হতে পারে। তবে কেউ কেউ আছেন যারা অন্যদের চেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ধরুণ যে কোন মানুষের বয়স, যারা ৩৫ এর পরে, যাদের ডায়াবেটিকস বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যাদের পরিবারে গ্লোকমার ইতিহাস রয়েছে, যারা অনেক বেশি পাওয়ারের চশমা পড়েন, যারা দীর্ঘদিন যাবৎ চোখের কঠিন কোন রোগে ভুগছেন, যাদের চোখে অতীতে আঘাতের ইতিহাস রয়েছে, যাদের দীর্ঘদিন ধরে চোখে ছানি পড়ে আছে তাদের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবন হতে পারে।
গ্লোকমা শুধু বড়দের নয়, একটি শিশুও জন্মের সময় গ্লোকমা রোগে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করতে পারে। আবার জন্মের পরেও আক্রান্ত হতে পারে।
অনেকে বলেন, ডাগর ডাগর চোখ, হরিণের মত চোখ। আসলে বড় চোখ দেখতে তো অনেক সুন্দর লাগে। কিন্তু এই সব ডাগর ডাগর চোখের আড়ালে অনেক কষ্ট, অনেক দু:খ লুকিয়ে থাকে। এই ধরণের শিশুদের চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়তে থাকে। এই রোগে আক্রান্তদের দৃষ্টি কমতে থাকে, চোখ ঘোলা হতে থাকে। ছোটদের ক্ষেত্রে একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে অপারেশন করা। অপারেশন না করলে প্রতিটি শিশুই অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : এই গ্লোকমার কি কোন প্রকারভেদ রয়েছে? এর উপসর্গ কি?
উত্তর : আসলে গ্লোকমা প্রধারণত দুই ধরণের। একটি ওপেন বা উন্মুক্ত কোন বিশিষ্ট গ্লোকমা। আর একটি ক্লোজ বা বন্ধ কোন বিশিষ্ট গ্লোকমা।
উন্মুক্ত কোন বিশিষ্ট গ্লোকমার ক্ষেত্রে চোখের সামনের প্রকোষ্ঠের যে কোনটি স্বাভাবিক থাকে কিন্তু যে রাস্তা দিয়ে জলীয় পদার্থ বেরিয়ে যায় সেই নির্গমন পথের ছাকনির ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে কোন উপসর্গ থাকে না। কেউ কেউৃ এসে বলেন যে আমার বয়স ৪০ হয়নি কিন্তু কাছে পড়তে অসুবিধে হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন আমার কাছে পড়তে গেলে যে চশমাটা তা ঘন ঘন পরিবর্তন করতে হচ্ছে। কেউ কেউ বলেন- রাতে আমার গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়। কেউ কেউ বলেন- সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে সমস্যা হয়। কেউ কেউ বলেন- আমি হাটতে গেলে পাশের অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছি।
অপরদিকে বন্ধ কোন বিশিষ্ট গ্লোকমার ক্ষেত্রে চোখের সামনের প্রকোষ্ঠের কোনটি সরু হতে হতে যেদিন বন্ধ হয়ে যায় তখন হঠাৎ করেই চোখে চাপ অনুভব হয়। চোখ লাল হয়ে যায়, অতিমাত্রায় তীব্র ব্যথা হয়। মাথা ব্যথা হতে থাকে। দ্রুত অপারেশন না করলে চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
প্রশ্ন : অনেকে আছেন যাদের দীর্ঘদিন যাবৎ চোখে ছানি পড়ে আছে। এতে কি গ্লোকমা হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে? ছানি আর গ্লোকমার মধ্যে কি কোন সম্পর্ক রয়েছে?
উত্তর : গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন যদি চোখের ছানি পুষে রাখি এর কারণে হঠাৎ করেই চোখে চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। সেটাকে আমরা বলি ছানি জনিত গ্লোকমা। ছানি থাকলে চোখের ভেতরের যে স্পেসটা থাকে তা কমতে থাকে আর চাপ বেড়ে যায়।
প্রশ্ন : গ্লোকমা রোগের চিকিৎসা কি?
উত্তর : গ্লোকমা সারা জীবনের অসুখ। গ্লোকমা নিরাময়যোগ্য নয়, নিয়ন্ত্রণযোগ্য অসুখ। চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হল যতটুকু দৃষ্টি অবশিষ্ট আছে সেটি ধরে রাখা। গ্লোকমা রোগ তিন উপায়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ওষুধ, লেজার চিকিৎসা এবং অপারেশনের মাধ্যমে। চোখে নিয়মিত ড্রপ দেয়াই গ্লোকমা রোগ চিকিৎসার মূল ভিত্তি। কিছু ড্রপ রয়েছে যেগুলো অ্যাকুয়াস হিউমার জলীয় পদার্থটির উৎপাদন কমিয়ে দেয় আবার কিছু ড্রপ রয়েছে যেগুলো ওই জলীয় পদার্থটির নির্গমনকে তরান্বিত করে। প্রয়োজনে স্বল্প সময়ের জন্য খাওয়ার ট্যাবলেটও দরকার হতে পারে। প্রথমেই চোখের চাপ কমানোর একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যাকে আমরা টার্গেট প্রেসার বলে থাকি। সেই লক্ষ্যেই এক বা একাধিক ড্রপ বা ট্যাবলেট এককভাবে বা যৌথভাবে ব্যবহার করা হয়। কোনো কারণে চোখের চাপ ওষুধের মাধ্যমে কমানো সম্ভব না হলে উন্মুক্ত কোণবিশিষ্ট গ্লোকমার ক্ষেত্রে লেজার ট্রাবিকুলোপ্লাস্টি এবং বন্ধ কোণবিশিষ্ট গ্লোকমার ক্ষেত্রে লেজার পেরিফেরাল আইরিডোটমি করা হয়। ওষুধ এবং লেজারের মাধ্যমে চোখের চাপ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না হলে ট্রাবিকুলেকটমি অপারেশন বা ভাল্ব ইমপ্লান্টের মাধ্যমে চোখের চাপ কমিয়ে আনা হয়।
শ্রুতিলেখন : সোহাগ আশরাফ
ভিডিও দেখতে চাইলে ক্লিক করুন :
এসএ/