ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিচার বিভাগের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:১০, ১৪ নভেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৬:১৩, ১৪ নভেম্বর ২০১৮

১৪ নভেম্বর এলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে চিরচেনা দুটি মুখ। বিচার বিভাগের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র সিনিয়র সহকারী জজ জগন্নাথ পাঁড়ে ও সিনিয়র সহকারী জজ শহীদ সোহেল আহমেদ। ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় তারা উগ্র জঙ্গিবাদীদের বোমা হামলায় নিহত হন। সেদিন বিশ্ববাসী জেনেছিল, বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ জঙ্গিবাদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

বোমা হামলায় নিহত দুই বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও শহীদ সোহেল আহমেদ আমার সহকর্মী ছিলেন। ১৯৯৮ সালের ২৪ জুন তারা দু`জনসহ আমরা ৯৯ জন সহকারী জজ দেশের বিভিন্ন জেলার জাজশিপে যোগদান করেছিলাম। অধস্তন আদালতের সর্বোচ্চ পদ জেলা ও দায়রা জজ। এই পদে বর্তমানে কর্মরত আমরা। বেঁচে থাকলে তারা দু`জনও আমাদের সঙ্গে জেলা ও দায়রা জজ হতে পারতেন। জঙ্গিদের নির্মম আঘাত শুধু তাদের ওপর ছিল না; ছিল দেশের বিচার বিভাগ তথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্র হত্যাকারীদের বিচার করে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। রায় কার্যকর হয়েছে; কিন্তু এ দেশে জঙ্গিবাদীদের হামলা এবং চক্রান্ত এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তারা এ দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। শেখ হাসিনা সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের অনেক বেআইনি কার্যক্রমকে রুখে দিতে পেরেছে। এ কারণেও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত `বাংলাদেশ`-এর সংবিধানের মূল লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাষ্ট্র হবে এটি। ফলে `বাংলাদেশ` নামক রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাগরণ গড়ে তুলে সব সময় এটিকে চলমান রাখতে হবে। জঙ্গিবাদীরা হিংসা বা ধ্বংসের মাধ্যমে যে সমাজ গড়ে তুলতে চায়, তা অব্যাহত থাকলে মানবসভ্যতা বিপন্ন হতে বাধ্য। সে কারণে আমাদের সমাজকে একটি শক্তিশালী প্রগতিশীল-সুকুমারবৃত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চিন্তা ও চর্চার প্রচার এবং প্রসার ঘটিয়ে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবকিছু করতে হবে।

সহকর্মী বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও শহীদ সোহেল আহমেদ জীবন উৎসর্গ করে আমাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথ দেখিয়ে গেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, তাদের দেখিয়ে যাওয়া পথে আমরা হাঁটতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদসহ এ দেশে এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঝরে যাওয়া রক্ত কখনও বৃথা যাবে না; আমরা এগিয়ে যেতে পারব।

১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সাল। দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় আমরা চাকরি জীবন অতিক্রম করেছি। ২০০৫ সালে জগন্নাথ-সোহেল নিহত হওয়ার পর ২০১৮ সালে আমরা সহকর্মী জগন্নাথ পাঁড়ের পৈতৃক ভিটা বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি! আজও পদ্মা গ্রামে যাওয়ার সরাসরি কোনো রাস্তা নেই। গ্রামের আইল ধরে হাঁটতে হয়। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এখন অবধি পদ্মা গ্রামে বিদ্যুৎ যায়নি। সেই গ্রামের একটি ছেলে পদ্মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-হাইস্কুল পেরিয়ে রাজধানী ঢাকার ঢাকা কলেজে পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। এ ঘটনা শুধু গল্প বা উপন্যাসে পাওয়া যাবে। জগন্নাথ পাঁড়ের জন্য ঢাকায় এসে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার লড়াইটা সত্যিই কঠিন ছিল। বিচার বিভাগেও মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন তিনি। জগন্নাথ পাঁড়ের পরিবার যে সময় একটু আশার আলো দেখেছিল, ঠিক সেই সময়েই জঙ্গিবাদীদের হামলায় তার পরিবারের স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটে। জগন্নাথ পাঁড়ের সেই বাড়িতে গিয়ে আমাদের চোখের জলে আমরা প্রিয় সহকর্মীকে স্মরণ করেছি। শহীদ সোহেল আহমেদ ছিলেন সচ্ছল পরিবারের সন্তান।

‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্র এখন সুযোগ্য নেতৃত্বে সঠিক পথে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই গতি চলমান রাখতেই হবে। আমাদের সম্পদ লুটকারী পাকিস্তান রাষ্ট্র বাংলাদেশের সমকক্ষ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তবে বিচার বিভাগের এই দুই শহীদের পরিবারকে আমাদের সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই তাদের আত্মবলিদান সার্থক হবে। আমরা বিচার বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় জঙ্গিবাদীদের হামলায় শহীদ হওয়া বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও শহীদ সোহেল আহমেদকে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করি।

বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ), জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি