ছাত্র-জনতার নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা আসছে শিগগিরই
প্রকাশিত : ০৯:৪৭, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। জুলাই-আগস্টের তীব্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে আন্দোলনকারীদের মাঝে শুরু হয় নতুন প্রত্যাশা। দেশের রাজনীতিতে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। রাজনীতিকে ‘দায়-দরদের’ রাজনীতি করে তোলার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে গত ৮ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের কিছু দিন পর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা জানায় সংগঠনটি। এই সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়- এমন মতাদর্শের লোকদের নিয়ে ‘মধ্যম পন্থা’র রাজনৈতিক দল যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চে নতুন দলের ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছে নাগরিক কমিটির একাধিক সূত্র।
নতুন দল গঠন নিয়ে সর্বত্রই চলছে নানান জল্পনা- কল্পনা। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে রাজনৈতিক মহলের আলোচনায়ও গুরুত্ব পাচ্ছে।
যারা শীর্ষ চার পদে থাকতে পারেন
নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের কাঠামোতে আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখপাত্র ও মুখ্য সংগঠক— এই চারটি পদ রাখা হবে। নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটওয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ—এই চারটি শীর্ষ পদে আসতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন জানান, একক নেতার সিদ্ধান্তে দল চালানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আমরা রাজনীতি করবো। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের এখানে একজন সাধারণ সদস্য ও দলীয় প্রধানের মতামত সমান গুরুত্ব পাবে।
আপাতত উপদেষ্টারা দল থেকে দূরে
প্রথম দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন, এমন আলোচনা চলছিল। তবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তারা আপাতত পদত্যাগ করবেন না। ভবিষ্যতে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে পারেন বলে সূত্র জানায়।
অব্যাহত থাকবে প্ল্যাটফর্মের কার্যক্রম
নতুন দল গঠিত হলেও নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রম চালু থাকবে। যারা সরাসরি রাজনীতিতে আসতে চান, তাদের নতুন দলে যোগ দিতে নাগরিক কমিটির সদস্য পদ ত্যাগ করতে হবে। তবে এক ব্যক্তির একইসঙ্গে দুটি প্ল্যাটফর্মে থাকা যাবে না বলে জানিয়েছেন সংগঠন দুটির শীর্ষ নেতারা।
মধ্যপন্থি আদর্শে দল গঠন
নতুন দলটি মধ্যপন্থি আদর্শে গড়ে উঠবে বলে জানিয়েছেন নেতারা। দলটির মূলনীতি হবে মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচার। নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বার্থ এবং ভবিষ্যৎ রক্ষার লক্ষ্যে ভিন্নমতের মানুষের একত্রিত হওয়ার সুযোগ রাখা হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, ‘আমাদের দলের আদর্শ হবে মধ্যমপন্থি। আমরা বাংলাদেশের প্রশ্নে আপসহীন এমন সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। সেই অনুযায়ী আমাদের দলের আদর্শ নির্ধারিত হবে।’
সংসদ নয়, গণপরিষদ নির্বাচন মুখ্য
দলটির লক্ষ্য আপাতত সংসদ নির্বাচন নয়। শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন, গণহত্যার বিচার এবং নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারকে প্রাধান্য দিয়ে গণপরিষদ নির্বাচন করাই হবে মুখ্য বলে মনে করেন নেতারা। সামান্তা শারমিন বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানকে সাংবিধানিকভাবে সমুন্নত রাখতে গণপরিষদের মাধ্যমেই পরিবর্তন আনতে হবে।’
এখনও চূড়ান্ত হয়নি রাজনৈতিক দলের নাম
নাগরিক কমিটির গঠনতন্ত্রের খসড়া জানুয়ারির শেষ নাগাদ প্রকাশিত হবে। সংগঠনের লিগ্যাল উইংয়ের নেতৃত্বে এটি তৈরি করা হচ্ছে। তবে নতুন রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র আলাদা হবে। নতুন দল গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক ধারা তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে দলের নাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
নাগরিক কমিটির উদ্যোগে রাজনৈতিক দল গঠন ও দলের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে সামান্তা শারমিন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের মাঝে এখনও কোনও আলোচনা হয়নি। আমরা খুব শিগগিরই এগুলো নিয়ে বসবো।
আহ্বায়ক কমিটি প্রতিনিধি কমিটি গঠন করবে
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় নাগরিক কমিটি থানা ও উপজেলা মিলিয়ে ১২৫টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করেছে। জানুয়ারির মধ্যে প্রায় সব থানা-উপজেলা কমিটি ঘোষণার লক্ষ্য নিয়েছে প্ল্যাটফর্মটি। থানা কমিটি গঠনের পর সংগঠনটির এখন লক্ষ্য পাড়া-মহল্লাভিত্তিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করা। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি গঠনের কাজ প্রায় শেষের দিকে। থানা ও উপজেলা কমিটি ঘোষণা শেষ হলেই এগুলো ঘোষণা হতে পারে।
নাগরিক কমিটির সূত্র জানায়, থানা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটিকে ‘প্রতিনিধি কমিটি’ ঘোষণা করে বলা হয়েছে—তারা যেন নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের তালিকা তৈরি করে। তবে জেলা পর্যায়ের কমিটি নিয়ে এখনও তাদের কোনও আলোচনা হয়নি।
‘ইনক্লুসিভ কমিটি’
গত ৮ সেপ্টেম্বর ৫৬ সদস্যের কমিটি ঘোষণার মাধ্যমে জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। এরপর গত ৩ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের ৭ জন আইনজীবীকে জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যুক্ত করা হয়। এই ৭ জনকে যুক্ত করার পর নাগরিক কমিটির সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২। এরপর ২৫ নভেম্বর কমিটিতে আরও ৪৫ জনকে যুক্ত করা হয়। ফলে কমিটির সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৭ জনে। সর্বশেষ ৪০ জন যুক্ত হওয়ায় জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৭ জন।
বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাবেক ডাকসু নেতা, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ, আইনজীবী, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। এছাড়া অ্যাক্টিভিস্ট, ইনফ্লুয়েন্সাররাও রয়েছেন। এটিকে ‘ইনক্লুসিভ’ বলে অবিহিত করছে নাগরিক কমিটি।
তরুণ নেতৃত্ব গুরুত্ব পাবে
রাজনৈতিক অঙ্গনে কানাঘুষা রয়েছে, একজন ‘কিং’ খুঁজছে দলটি। যাকে সামনে রেখে জনগণের আস্থা অর্জন করতে চায় তারা। কিং হিসেবে নাম শোনা গেছে কয়েক ব্যক্তির। তবে জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে- এসব নিয়ে তাদের মাঝে কোনও আলোচনা নেই। কেউ কেউ হয়তো কিংস পার্টি বানানোর কথা ভাবতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে জাতীয় নাগরিক কমিটি তা হতে দেবে না।
জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের রাজনৈতিক দলে তরুণ নেতৃত্বকে গুরুত্ব দেবে। সামান্তা শারমিন বলেন, ‘নতুন রাজনৈতিক দলে আমরা অবশ্যই তরুণ নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেবো।’
নতুন দল লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি করবে না
২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ১৮টি জেলা, তিনটি মহানগর, একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আহ্বায়ক কমিটি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর মধ্যে সর্বশেষ গাইবান্ধায় ২৩৮ সদস্যের কমিটি করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা পর বৈষম্যবিরোধীরা স্ব-উদ্যোগী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। এটি কোনও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে না বলে জানিয়েছেন আরিফ সোহেল। তিনি বলেন, ‘আমরা কখনোই এটিকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ঘোষণা করবো না। এটি তার নিজের মতোই কাজ করবে। ছাত্রদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ঘোষণা মানেই লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি এসে যায়। যেহেতু আন্দোলনের অন্যতম একটি স্পৃহা ছিল লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা, তাই আমরা সেটি করবো না।
আপাতত ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা নেই
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম একটি দাবি ছিল সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত জারি রাখা। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে অফিসিয়ালি বসলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বসা হয়নি বলে জানিয়েছেন আরিফ সোহেল।
ন্যূনতম যৌক্তিক সময়ের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে তারা কথা বলবেন বলে জানান। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোনও প্যানেল দেওয়ার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনও পরিকল্পনা নেই বলে জানান আরিফ সোহেল।
এসএস//
আরও পড়ুন