চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষা-২০২৩
ছিলেন না পরীক্ষার দায়িত্বে, তবুও তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি
প্রকাশিত : ২১:৪৩, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
ছিলেন না পরীক্ষা কার্যক্রমের দায়িত্বে, তবুও তাঁর বিরুদ্ধে গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। তাঁর নাম নারায়ন চন্দ্র নাথ। তিনি প্রফেসর এবং চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব এবং চলতি দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান।
একটি অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর ছেলের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের কথিত জালিয়াতির বিষয়টি তদন্ত শুরু করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটি। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশান উইং) প্রফেসর মো. আমির হোসেন। অন্য দুই সদস্য হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (এইচআরএম) আশেকুল হক ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ইএমআইএস সেল-এর খন্দকার আজিজুর রহমান। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
২০২৩ সালের এইচএসসিতে নিজ সন্তান পরীক্ষার্থী হওয়ায় প্রফেসর নারায়ন লিখিতভাবে পরীক্ষার সব গোপন কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি চেয়ে বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান বরাবরে ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি আবেদন করেন। তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে তৎকালীন বোর্ড চেয়ারম্যান এ সংক্রান্ত একটি অফিস আদেশ জারি করেন একই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি, যার স্মারক নম্বর চশিবো/ প্রশা-২/ জেনা-৫/ ৯৫ (অংশ-৩২)/ অফিস আদেশ (অন্যান্য)/ ১৫৬(৭), তারিখ: ১২/২/২৩। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার মুহূর্তে প্রফেসর নারায়নকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে সরিয়ে বোর্ডের সচিব পদে পদায়িত করে মন্ত্রণালয়। ফলে, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও পূর্বের দ্বন্দ্বের জের ধরে বিদ্বিষ্ট পুরনো সহকর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে গায়েবি অভিযোগ তোলেন।
উল্লেখ্য, প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র নাথের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। শুধু বাংলা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সে এ-প্লাস পায়। কিন্তু চতুর্থ বিষয়ে এ-প্লাস পাওয়ায় সামগ্রিক ফলাফল তার জিপিএ-৫ হয়। কিন্তু বাংলায় এ-প্লাস না পাওয়ায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে বোর্ডের নিয়মানুযায়ী পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করতে গেলে দেখতে পায়, কে বা কারা আগে থেকেই সব বিষয়ের জন্য আবেদন করে রেখেছেন। এই ঘটনায় নিজের সন্তানের জন্য শঙ্কিত হয়ে মা বনশ্রী নাথ পাঁচলাইশ থানায় গত ৪ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
পুনঃনিরীক্ষণের জন্য যে ব্যক্তি আবেদন করেছেন তা বের করতে সেই জিডিতে উল্লেখ করা হয়। পরে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ তদন্ত করে দেখতে পায়, পুনঃনিরীক্ষণের আবেদনে রেফারেন্স হিসেবে মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে বোর্ডের সাবেক সচিব প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আলীমের। দুজন দীর্ঘ সময় একই কর্মস্থল চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে থাকায় তাঁদের মধ্যে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, যার ঢেউ আছড়ে পড়েছে প্রফেসর নারায়নের ছেলের এইচএসসি ফলাফলের ওপর। জিডির ঘটনায় পুলিশ তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করার পর সাইবার অপরাধ আইনে একটি মামলা করেন বনশ্রী নাথ। মামলাটি এখন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম তদন্ত করছে।
প্রফেসর নারায়নের কারণে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে একটি ইতিবাচক কর্মপরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বোর্ডে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ উপকারভোগীরা। তাঁর দক্ষ, যোগ্য ও গতিশীল নেতৃত্বের কারণে তা সম্ভব হয়। অথচ বাইরের একটি গ্রুপ যারা আগে একসময় এই বোর্ডে বিভিন্ন মেয়াদে কর্মরত ছিলেন তারাই মূলত প্রফেসর নারায়নের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে বলে অনেকে মনে করেন। এই চক্রের সদস্যরা আবার বোর্ডে ফিরে আসার জন্যে মরিয়া। তাদের মূল উদ্দেশ্য প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র নাথ যাতে কোনোভাবেই চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে না পারেন। তদন্তের মাধ্যমে বোর্ডের ভেতর ও বাইরের এই হীনম্মন্য জঘন্য চক্রটিকে চিহ্নিত করা গেলে তার উপকারভোগী হবে এই শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজন।
সরকারি কলেজের একাধিক প্রবীণ অধ্যাপক জানান, ২০২৩ সালের এইচএসসি ফলাফল তৈরির সঙ্গে প্রফেসর নারায়নের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কারণ, তিনি লিখিতভাবে আবেদন করে পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন এবং তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে অফিস আদেশও জারি করা হয়। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার আগেই তাঁকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে সরিয়ে বোর্ডের সচিব করা হয়। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে কাল্পনিক বা গায়েবি অভিযোগ তোলা দুঃখজনক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এমনিতে পরীক্ষার ফলাফল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তৈরি করেন না বলে প্রবীণ শিক্ষকেরা জানান। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কেবল তদারকি করেন। ফলাফল তৈরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেন কম্পিউটার সেলে নিযুক্ত সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট এবং প্রোগ্রামার-বৃন্দ।, শিক্ষা বোর্ড আইনেও এ সংক্রান্ত কাজে সচিবের যুক্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই।
প্রবীণ শিক্ষকেরা আরও জানান, বোর্ডের অভ্যন্তরে আসলে কী ঘটেছে তা অভিযোগকারী ও ফলাফল তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত বোর্ডের কর্মরত ব্যক্তিরা ভালো জানেন। তবে কাউন্টার টেররিজমও মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আদালতে প্রতিবেদন দিলে কুচক্রীদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। না হলে এসব কদর্য অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের পালা কখনও শেষ হবে না।
প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র নাথ এ প্রসঙ্গে জানান, তাঁর বিরুদ্ধে একটা কুচক্রী মহল ক্রমাগত কুৎসা রটিয়ে যাচ্ছে। এই কুচক্রী মহলকে প্রশ্রয় দিচ্ছে গুটিকয়েক ব্যক্তি যাদের সবাই চেনেন। সর্বশেষ ফলাফল জালিয়াতির গুজব রটানো হয়েছে। অথচ তিনি ফলাফল তৈরির কার্যক্রমে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক প্রদীপ চক্রবর্তীও মনে করেন, প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে একটি গ্রুপ অপতৎপরতায় লিপ্ত। বোর্ডে থাকাকালীন এরা পদে পদে তাঁকেও প্রতিটি কাজে বাধা দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছে। মূলত শিক্ষা বোর্ডের ওপর যে জনআস্থা তৈরি হয়েছে তা বিনষ্ট করতে এই চক্র বর্তমান সচিবকেও বানোয়াট অভিযোগে অভিযুক্ত করার সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও দুরভিসন্ধিমূলক বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আরও পড়ুন