ছোট স্বপ্ন থেকে সাহসী উদ্যোক্তা সাবরিনা জামান
প্রকাশিত : ১৪:৪৭, ২৩ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ১৭:১৭, ১৪ মে ২০১৯
ইমপ্যাক্ট পিআর-এর প্রধান নির্বাহী সাবরিনা জামান
সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার পথের বাঁকে থাকে ছোট ছোট অনেক গল্প। যে গল্প বিশ্বাসের, যে গল্প পরিশ্রমের, যে গল্প ধৈর্য্য ধারনের, যে গল্প সাহসীকতার। ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় পথচলা। নানা বাধা আসে চলার পথে। ঝুঁকি সামলে নিতে না নিতে আবার ঝুঁকি আসে। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, নিজের পেশা নিয়ে সংশয়, সফল হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়; একজন উদ্যোক্তার এসবগুলো অভিজ্ঞতাই অর্জিত হয়ে যায়। ঠিক তেমনি এতসব বাঁধা পেরিয়ে সফল ও সাহসী উদ্যোক্তা হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করছেন ইমপ্যাক্ট পিআর-এর প্রধান নির্বাহী সাবরিনা জামান।
দীর্ঘ ১২ বছর এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসাবে কাজ করছেন। অর্জন করেছেন সুখ্যাতি। প্রথম দু’জনের হাত ধরে প্রতিষ্ঠান শুরু করলেও বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে অর্ধ-শতাধিক লোক কাজ করছে। রসুইঘরের বদলে এখন তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় প্রতিষ্ঠানটি সামলানোর কাজে। তবে এই সাফল্যের পথটা মসৃণ ছিল না। নিজের সাহসী উদ্যোক্তা হয়ে উঠার সার্বিক বিষয় নিয়ে সাক্ষাতকার দিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান।
একুশে টিভি অনলাইন: ইমপ্যাক্ট পিআর বাংলাদেশে প্রথম পিআর এজেন্সি এটা সবাই জানে। প্রশ্ন হলো- কিভাবে এর পথচলা শুরু হয়-
সাবরিনা জামান: প্রকৃত অর্থে পিআর যে আলাদা একটি সার্ভিস সেক্টর হতে পারে সেটা নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ করে ইমপ্যাক্ট পিআর। শুরুতে আমাদের মাথায় চিন্তা আসে যে বাংলাদেশে এ ধরনের কাজের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। তবে অর্থ সংকটের কারণে আমরা নিজ থেকে কাজটা শুরু করতে পারেনি। কারণ আমি একটা ছোট চাকরি করি। যা দিয়ে এমন কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব ছিলো না। যে কারণে আমরা উদ্যোক্তা খোঁজা শুরু করলাম। এই আইডিয়া নিয়ে দেশের বড় বড় কয়েকটি বিজ্ঞপনী সংস্থার মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে এবং বোঝানোর চেষ্টা করলাম, দেশে পিআর নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তাদের কারো পক্ষেই দেশে পিআরের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি এবং পিআর এজেন্সি শুরুর বিষয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তারা বললেন- এর মাকের্ট তৈরি করা বাংলাদেশে কোন দিন সম্ভব নয়। এমন আচরণের কারণে শুরুতেই আমরা কিছুটা পিছিয়ে গেলাম।
একুশে টিভি অনলাইন: পিছিয়ে গিয়ে আবার কিভাবে সামনের দিকে এগুলেন?
সাবরিনা জামান: তবে নিজের উপর বেশ আত্মবিশ্বাস ছিল। মনে হয়েছে-এখানে সম্ভাবনাময় কিছু করার বেশ সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে এই মাকের্টটা এমনিতেই পড়ে রয়েছে। কেউ এটা নিয়ে কাজ করছে না। পরিশেষে আমি নিজে এবং বর্তমানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির প্রধান নির্বাহী এবং ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টের সম্পাদক মো. শামসুর রহমান, নামকরা ব্যবসায়ী ইন্টারন্যাশনাল অফিস ইকুইপমেন্ট (আইওই) এর সিইও এবং আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (অ্যামচেম) এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আফতাব উল ইসলাম এর সঙ্গে আলাপ করি। তিনি আইডিয়াটা স্বাদরে গ্রহণ করেন এবং পিআর এজেন্সি চালু করার জন্য সার্বিক সহায়তা করেন। এভাবে ২০০৫ সালে দু’জনের হাত ধরে দেশের প্রথম পিআর এজেন্সি হিসেবে ইমপ্যাক্ট পিআরের যাত্রা শুরু।
তবে প্রথম ৫-৬ বছরের পথ চলা খুবই কঠিন ছিলো। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে, ব্যবসায়ীদের কাছে বার বার গিয়ে বুঝাতে হয়েছে পিআর কি। তবুও তারা বুঝতে চেষ্টা করেনি। বড় বড় কোম্পানির কাছে গিয়ে পিআর সম্পর্কে ব্রিফ করতে হতো। কারণ বিষয়টি সবার কাছেই একেবারে নতুন ছিল। সেসময় এশিয়া এনার্জি নামে একটি বহুজাতিক জ্বালানী কোম্পানি এবং দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপ বেক্সিমকো তাদের সবগুলো কোম্পানির পিআর এর জন্য ইমপ্যাক্ট পিআরকে দায়িত্ব দেয়। শুরুতে এই দুইটি কোম্পানি নিয়ে আমাদের পথচলা শুরু হয়।
একুশে টিভি অনলাইন: বর্তমানে এই সেক্টরের অবস্থা কেমন?
সাবরিনা জামান: বর্তমানেও আমরা অনেকগুলো বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা সম্মুখীন হচ্ছি। এখনও মার্কেট বুঝে না পিআর কি। আপনি যদি ৫ বছর আগে প্রশ্ন করতেন পিআর কি, আমি বলতাম ভালো প্রেস রিলিজ লেখা পিআর এজেন্সির কাজ। একটা ভাল সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করে দেওয়া পিআর এজেন্সির কাজ। গণমাধ্যমে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত দায়িত্ব পিআর। কিন্তু এই ধারণার পরিবর্তন এসেছে।
এই জায়াগ থেকে আমরা অনেকটা বের হয়ে এসেছি। প্রথম কয়েকবছর ইমপ্যাক্ট পিআর একচেটিয়া ব্যবসা করে। তারপর ধীরে ধীরে অন্যান্য পিআর এজেন্সি বাজারে আসলে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। এতএব আমরা কিছুটা হলেও এর গুরুত্ব বুঝাতে সক্ষম হয়েছি।
একুশে টিভি অনলাইন: দেশে এখন অনেকগুলো পিআর এজেন্সি। মূলত পিআর এর কাজ কি?
সাবরিনা জামান: বর্তমানে আমরা পিআর এজেন্সির গুরুত্ব মাকের্টে তৈরি করেছি। একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। ধরুন একুশে টিভি অনলাইনকে বাংলাদেশে ১ নম্বর অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসাবে দেখতে চায়। এজন্য পিআর এজেন্সি যা করা দরকার তাই করবে। পিআর এজেন্সি এক বছরের একটা কেলেন্ডার তৈরি করে দিবে। যেখানে এবছরে কিভাবে ১ নম্বর নিউজ পোর্টাল হবে তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া থাকবে।
আর পিআর এজেন্সির কাজ হলো এই এক বছরে সঠিক সেবা নিশ্চিত করে ইটিভি অনলাইনকে বাংলাদেশের ১ নম্বর নিউজ পোর্টাল হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করানো। তবে এমন সার্ভিসটা সব পিআর এজেন্সির মধ্যে নেই। সেক্টরটা এখনও নতুন এবং এর কোন প্ল্যাটফর্ম বা গাইডলাইন নেই। এ কারণে প্রতিটি পিআর অ্যাক্টিভিটির জন্য কোন স্টান্ডার্ড মূল্য নির্ধারিত হয়নি। একই কাজের জন্য একেক এজেন্সি একেক ধরণের অসম বাজেট দেয়। এতে ক্লায়েন্ট বা কোম্পানিগুলো দ্বিধায় পড়ে যায়। এ কারণে পিআর এজেন্সিগুলোর একটি আলাদা প্লাটফর্ম থাকা জরুরি।
একুশে টিভি অনলাইন: এই প্লাটফর্ম নিয়ে আপনাদের স্বপ্ন বা ভবিষৎ পরিকল্পনা কি?
সাবরিনা জামান: আমাদের একটা ছোট স্বপ্ন আছে। সেটা হচ্ছে আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিটা ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করাবো। বাংলাদেশে পিআর এজেন্সি হবে। যখন এই ইন্ডাস্ট্রিটার গুরুত্ব মানুষ ভালভাবে বুঝতে পারবে। তখন ইমপ্যাক্ট পিআর সকল পিআর এজেন্সি নিয়ে একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করবে। যার মাধ্যমে সকল পিআর এজেন্সি পরিচালিত হবে। আমি অনেক বার এ ইন্ডাস্ট্রিটা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে চেয়েছি। কিন্তু আমার স্বপ্ন আমার নেশার কারণে বার বার ফিরে এসেছি। বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৩০জন লোক কাজ করে। আশা করি আমার স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে।
একুশে টিভি অনলাইন: পড়ালেখার জন্য দেশের বাহিরে চলে গিয়েছিলেন। বিদেশে স্থায়ী না হয়ে দেশে কেন ফিরলেন?
সাবরিনা জামান: এর মূল কারণ ছিল আমার বাবা-মা। দ্বিতীয় কারণ ছিল দেশপ্রেম, তৃতীয় আমার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আমি বিদেশ থেকেও ইমপ্যাক্ট পিআরে কাজ করতাম। আমি জন্মগতভাবে ব্রিটেনের নাগরিক ছিলাম। চাইলে ওই দেশে অনেক ভালকিছু করতে পারতাম। শুধু আমার বাবা-মা, আমার দেশপ্রেম এবং আমার স্বপ্ন আমাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছে।
একুশে টিভি অনলাইন: এমন পেশায় কেন আসলেন?
সাবরিনা জামান: সত্যি কথা বলতে আমি নতুন মানুষের সঙ্গে কাজ করতে ভালবাসি। একইসঙ্গে আমি কথা বলতে খুব পছন্দ করি। এবং মানুষ আমার কথা শুনতেও পছন্দ করে। কাজেই মার্কেটিং, সেলস এসব জায়গাতেই আমার চলে যাওয়া উচিত। তবে পর্যটন, হসপিটালিটি বা সেলস-মার্কেটিং জগতে এসে ছোট-খাটো একটি চাকরি করেছি কিছুদিন। আমি যখন মাস্টার্স পরীক্ষা দেই তখন পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখি, ডাচ এয়ারলাইন্স কেএলএম তাদের সেলস টিমে লোক নেবে। সেখানে আমি ইন্টারভিউ দেই এবং চাকরিটা পাই। বাংলাদেশে কেএলএম-এর অপারেশন বেশ ছোট ছিল এবং তাদের সেলস আর মার্কেটিং একই টিম করতো। সেখানেও তাদের কথা সহজেই মানুষকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম, এবং বুঝলাম গণসংযোগের পেশাটাই আমার জন্য উত্তম হবে।
একুশে টিভি অনলাইন: এই সেক্টর সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে চান?
সাবরিনা জামান: কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এই পেশা সম্পর্কে অনেকে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। কিছু এজেন্সির নেতিবাচক চর্চার কারণে এমনটি হয়েছে। অনেকে ভাবেন টাকা দিয়ে কাজ করায় পিআর এজেন্সি। তবে যারা এমনটি করে তারা বেশিদিন মার্কেটে টিকতে পারে না। কাজের মূল্যায়ন সবখানে আছে। আমি দেখেছি, অনেক ক্লায়েন্ট আমাদের কাছ থেকে চলে গিয়ে বাজেটের দিক বিবেচনা করে, আবার ফিরে এসেছে শুধুমাত্র কাজে মুগ্ধ হয়ে। অবাস্তব আশা দিয়ে কাজ নিয়ে ক্লায়েন্ট অসন্তুষ্ট করা কোন ভাবেই ঠিক নয়। এজন্যই প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে টিকে আছি। তবে এই সেক্টরে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সেক্টরটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। সে সঙ্গে বিদেশি বহুজাতিক পিআর এবং কমিউনিকেশন এজেন্সিগুলোর সঙ্গে দেশিও অনেক এজেন্সি সরাসরি কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মানের পিআর চর্চা হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এটি বড় একটি সার্ভিস সেক্টর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
একুশে টিভি অনলাইন: একজন উদ্যোক্তা অর্থনৈতিক সংকট কিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারে?
সাবরিনা জামান: আমার মনে হয় উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন হয় না। স্বপ্ন বাস্তাবায়নে সংগ্রামের প্রয়োজন হয়। কোন ব্যক্তি যদি স্বপ্ন দেখে যে উদ্যোক্ত হতে চায়। তাহলে অবশ্যই তার অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে। পরিকল্পনার কথা বলতে হবে, যদি সে ব্যক্তি অর্থ দিতে রাজি হয় তাহলে পথে নামতে হবে। এই পথ আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।
টিআর/এসি
আরও পড়ুন