জঙ্গি তৎপরতা থেমে নেই
প্রকাশিত : ০০:০৩, ১৭ জুলাই ২০১৯
সারাবিশ্বের জঙ্গি সংগঠনগুলোর মা-বাবা আল কায়েদা ও আইএস এখন অনেকটাই কোণঠাসা। ইরাক ও সিরিয়া থেকে উৎখাতের পর আইএস ছত্রভঙ্গ এবং দিশাহারা। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে আইএস বাহিনীতে যোগ দেওয়া মোট সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫ হাজার। এদের বৃহৎদাংশ ইরাক-সিরিয়ার যুদ্ধে নিহত হয়েছে। জীবিতদের একাংশ বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী আছে। তার মধ্যে আবার বেশিসংখ্যক বন্দী আছে ইরাক-সিরিয়ার উত্তরাংশে যুদ্ধরত কুর্দি বাহিনীর হাতে। অপর একটি অংশ দলছুট হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় অন্যান্য দেশের জঙ্গিদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে আইএসের আবির্ভাবের পর থেকে আল কায়েদার নামে সক্রিয় বাহ্যিক অপারেশনাল তৎপরতা তেমন একটা দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাপী সব জঙ্গি তৎপরতাই ঘটেছে আইএসের নামে। তার মানে এই নয় যে, আল কায়েদা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে বা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, মোটেও তা নয়। বরং মাঠের তৎপরতা আইএসের কাছে ছেড়ে দিয়ে জঙ্গিবাদ বিস্তারে আল কায়েদা ব্যাপকভাবে কাজ করেছে।
আল কায়েদা ও আইএসের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। লক্ষ্য অর্জনের কৌশল ও নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। মৌলিক পার্থক্য নেই বলেই দেখা যায় সোমালিয়ার জঙ্গি সংগঠন, যারা আল কায়েদার গর্ভ থেকে জন্ম এবং পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠেছে, সেই আল শাবাব ২০১৪ সালের পর রোমাঞ্চকর উত্থানে অভিভূত হয়ে আইএসের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দেয়। ২০১৪ থেকে ২০১৬, এই তিন বছর আইএসের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা এবং ইউরোপব্যাপী অনেকগুলো বড় আকারের রক্তাক্ত আক্রমণ চালাতে সক্ষম হওয়ায় সারা বিশ্বজুড়ে আইএসের নামে একটা ভীতি ও ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই সুযোগটাই নেয় বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের জঙ্গি সংগঠনগুলো। আল কায়েদা থেকে জন্ম হলেও সোমালিয়ার আল শাবাব, নাইজেরিয়ার বোকো হারাম এবং পাকিস্তানে তেহরীক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) তড়িঘড়ি করে আইএসের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দেয়। আল কায়েদাসহ সকল জঙ্গি সংগঠনের নেতারা ভালো করেই জানে, বুঝে এই একবিংশ শতাব্দিতে চোরাগুপ্তা ও আত্মঘাতী হামলা বা বিচ্ছিন্ন কিছু সশস্ত্র সহিংসতার মাধ্যমে তারা কখনোই তাদের কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। কিন্তু বিক্ষিপ্ত মানুষ হত্যার মাধ্যমে সাধারণ জনমানুষের ভেতরে ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি করতে পারলে সহজেই তারা জনস্রোতের সঙ্গে মিশে অবস্থান করতে পারে, মানুষ ভয়ে তাদের সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করে না এবং বিরুদ্ধেও যায় না। এতে তাদের অনেক সুবিধা।
সে কারণেই আমরা দেখেছি ২০১৫ সালে নাটোরের নিভৃত পল্লীর এক দুর্বল গরীব মুদি দোকানদার সুনীল গোমেজকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গিরা হত্যা করার পর মুহূর্তেই গায়েবী আওয়াজের মতো ঘোষণা আসে আইএস সুনীল গোমেজকে হত্যা করেছে। সুনীল গোমেজের মতো একজন দুর্বল মানুষকে হত্যা করে আইএসের কি লক্ষ্য অর্জিত হয় বা হয়েছে তার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাদের মনে হতে পারে আইএসের নাম শুনলেই অনেকের হাঁটুতে কম্পন ধরে যাবে। এখন তো একটা পটকা ফুটলেও আইএসের দায় স্বীকারের কথা শোনা যায়। আইএস আইএস রবের পেছনে বৈশ্বিক বড় শক্তির ভূ-রাজনীতির খেলা থাকতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।
আইএস আপাতত কোণঠাসা এবং আল কায়েদা নীরব আছে বলে এমন ভাববার কারণ নেই যে, এই অপশক্তির কবল থেকে বিশ্ব মুক্ত হয়ে গেছে। ইরাক, সিরিয়া থেকে দলছুট পলায়ন পর জঙ্গি সদস্যরা গোপনে, ছদ্মবেশে নিজ নিজ দেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করবে। এরা যেখানে, যে দেশেই যাক, সেখানে তারা প্রতিশোধ পরায়নতার প্রতিহিংসায় আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। পুলিশের ভাষ্য মতে বাংলাদেশ থেকে ৪০ জন জঙ্গি আইএসে যোগ দেয়। তবে আমার ধারণা এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। তবে সংখ্যা নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে না থেকে আমাদের সতর্ক হতে হবে যাতে ইরাক, সিরিয়া থেকে পলায়নপর জঙ্গিদের কেউ যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে। তার জন্যে সকল বিমান, নৌ, স্থল বন্দরসহ পুরো সীমান্ত জুড়ে বিশেষ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তারপর অন্য কোন দেশের ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে এনজিও বা ধর্মীয় সংগঠনের ছদ্মবেশে যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে তার জন্য বাড়তিভাবে সতর্ক হতে হবে।
এ বিষয়ে সবচেয়ে ভয়ের ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা হচ্ছে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আগমন ও অবস্থান। ইরাক, সিরিয়ার বাংলাদেশী জঙ্গিরা মিয়ানমারের রাখাইন হয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে কক্সবাজারে প্রবেশ করা তাদের জন্য খুব কঠিন কাজ হবে না। আর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ভেতরে বহু ধরনের অপতৎপরতা চলছে, যার খবর প্রতিনিয়তই আসছে। এই সময়ে জঙ্গি উৎপত্তি ও বিস্তারের জন্য সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার বিষফোঁড়া হয়ে আছে রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত যেতে পারে সে চেষ্টা তো থাকতেই হবে। তবে এই সময়ে সবচাইতে বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত কিভাবে এত বিশাল সংখ্যক সব হারানো হতাশাপূর্ণ মানুষকে সঠিক কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে আনা যায় সেই ব্যবস্থা করা, যাতে এদের মধ্যে থেকে কেউ যেন জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়তে না পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি সংগঠনগুলো যে বসে নেই সে খবর প্রায়শই পত্র-পত্রিকায় আসছে। গত ১১ জুলাই কালের কণ্ঠে একটা বড় খবর ছিল, আত্মঘাতি জঙ্গি ইউনিট তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বহু কলাকৌশলে নারীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। কারণ নারীদের আত্মঘাতী বানানো যেমন সহজ, তেমনি নারী জঙ্গিদের দ্বারা আত্মঘাতী হামলা চালানোও সহজ। জঙ্গি সংগঠনগুলো দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় ধর্মভীরু নারী-পুরুষদের টার্গেট করছে। বিশেষ করে যেসব নারী ধর্মের কথা বললেই দুর্বল হয়ে পড়ে তাদের বেছে বেছে দলে ভেড়ায়। এক্ষেত্রে দরিদ্র ও অভাবী পরিবারের ছেলেমেয়েরাই বেশি করে ফাঁদে পড়ছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রেমের ফাঁদে পড়া চট্টগ্রামের একটি কলেজের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে অধ্যায়নরত সাফিয়া আক্তার তানজী নামের একজনকে র্যাব ইতিমধ্যেই উদ্ধার করেছে। সুতরাং বলতেই হবে জঙ্গিরা থেমে নেই।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমন ও নিয়ন্ত্রণে একটা সাফল্য দেখিয়েছে, একথা বলতেই হবে। তবে জঙ্গিবাদ, অর্থাৎ তাদের কথিত আদর্শের বিস্তার রোধে এবং নতুন নতুন জঙ্গি তৈরির নেটওয়ার্ক বন্ধে খুব একটা কার্যকর অগ্রগতি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। ফেসবুক ইউটিউব খুললেই হাজার হাজার জঙ্গিবাদী উপাদান সেখানে দেখা যায়। ফেসবুক ইউটিউব বন্ধ করা যাবে না, এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তার কূপ্রভাব থেকে জাতি রাষ্ট্রকে বাঁচানোর পন্থা বের করতে না পারলে বিপদ থেকে কখনোই আমরা মুক্ত হতে পারবো না।
তারপর জঙ্গি রিক্রুটমেন্টের একটা ফিজিক্যাল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশব্যাপী রয়েছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কিভাবে সরল সহজ ধর্মভীরু যুবকদের জঙ্গি দলে ভেড়ানো হচ্ছে তার বড় দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয় বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ইংরেজি দৈনিকে ২০১৬ সালের ২৪ ও ২৬ জুলাই। ২৪ জুলাই ছাপা হয় শুদ্ধস্বরের টুটুল হত্যা চেষ্টায় অংশ নেওয়া সুমন হোসেন পাটওয়ারীর জঙ্গি হয়ে ওঠার বিস্তারিত বিবরণ। ২০১৬ সালের ১৫ জুন হাটহাজারী থেকে সুমনকে গ্রেফতার করা হয়। সুমনদের মূল বাড়ি চাঁদপুর। কিন্তু সে তার বাবার সঙ্গে চট্টগ্রামের হালিশহরে থাকত। হালিশহরের মসজিদে সুমনের পরিচয় হয় কাওসার নামক এক নেটওয়ার্ক কর্মীর সঙ্গে, যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে কয়েক মাসের ভেতর ধাপে ধাপে সুমন হোসেনের গুরু বা মন্ত্রদাতা বদল হতে হতে পঞ্চমজন, যার নাম মাহমুদ তাকে জিহাদী মন্ত্রে পরিপূর্ণ দীক্ষা দান সম্পন্ন করে। এই নেটওয়ার্কের একজনের থেকে শিকার অন্যজনের হাতে গেলে পূর্ববর্তী জনের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ বা সংযোগ থাকে না। জঙ্গি নেটওয়ার্কে যুক্ত কর্মীগণ একেকজন শুধুমাত্র পূর্ববর্তী ও পরবর্তী, এই দুইজনের সঙ্গে সংযোগ থাকে। এর বাইরে নেটওয়ার্কের অন্য কারো সঙ্গে তাদের সংযোগ থাকে না এবং কেউ কারো সঠিক পরিচয়ও জানে না।
জঙ্গিয়ায়নের এই নেটওয়ার্ক বহাল থাকলে, ফেসবুক, ইউটিউবে ধর্মের অপপ্রচার চলতে থাকলে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জায়গা অটুট থাকলে জঙ্গিবাদের বিস্তার এবং জঙ্গি রিক্রুটমেন্ট থেমে থাকবে না। প্রধানত তিনটি মৌলিক কারণের জন্য বাংলাদেশ জঙ্গি হামলার হুমকি থেকে সহজে শঙ্কা মুক্ত হতে পারবে না। প্রধান ও একনম্বর কারণ হলো, একাত্তরের পরাজিত ও পরিত্যক্ত ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি, যা এখনো বাংলাদেশে প্রবলভাবে উপস্থিত। দ্বিতীয়ত, কূটনৈতিক সম্পর্কের আশ্রয়ে ও ছদ্মবেশে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত। তৃতীয়ত, বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি তৎপরতার প্রভাব। গত তিন বছরে আমরা একটা স্বস্তিকর অবস্থায় আছি, সেটি বজায় রাখতে হলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বহুমুখী জনসেচতনামূলক কর্মসূচি ব্যাপক হারে অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের বাহিনীসমূহের পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আরো অনেক গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় খাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে, যাতে আমাদের নতুন প্রজন্মের মনমানসিকতায় যেন ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদিতার কোন স্থান না থাকে। আমাদের ধরেই নিতে হবে জঙ্গিরা থেমে নেই, থেমে থাকবে না।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
sikder52@gmail.com
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।