জঙ্গিরা কিন্তু বসে নেই
প্রকাশিত : ১১:২১, ৩ মার্চ ২০২০
মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.)
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ততম এলাকা দুই নম্বর গেট মোড়ে অবস্থিত পুলিশ বক্সের ভেতরে বোমার বিস্ম্ফোরণ ঘটেছে। তাতে শিশু, পথচারী, কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যসহ ৪ জন আহত হয়েছেন। বোমা বিস্ম্ফোরণের পর তোলা ও পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশ বক্সের ছবি দেখে মনে হয়, পুলিশ বক্সের ভেতরেই বোমাটি বিস্ম্ফোরিত হয়েছে। হতে পারে এটা সময় নিয়ন্ত্রিত বোমা ছিল এবং সেট করা নির্দিষ্ট সময়েই বিস্ম্ফোরণ ঘটে গেছে। হয়তো ভাগ্যক্রমে ওই সময়ে পুলিশ বা অন্য কেউ ভেতরে ছিল না।
আবার হতে পারে এটা ছিল দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত বোমা। বোমাটি যে বা যারাই বিস্ম্ফোরণ ঘটিয়ে থাকুক না কেন, তারা হয়তো বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটাতে চায়নি। শুধু ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি করা অথবা নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্যই এটা করেছে।
প্রশ্ন হলো, পুলিশ বক্সের ভেতরে তারা বোমাটি স্থাপন করার সুযোগ পেল কীভাবে? সন্ধ্যার পরপরই ঘটনাটি ঘটেছে। তাতে বোঝা যায়, সকাল থেকেই সেখানে বক্সের ভেতরে অথবা আশপাশে অনবরত পুলিশ কর্তব্যে ছিল। কোন ফাঁকে কী করে তারা বক্সের ভেতরে বোমাটি স্থাপন করতে পারল! তাতে বোঝা যায়, যখন যারাই কর্তব্যে ছিলেন তাদের পরিচিত কেউ ছদ্মবেশে পুলিশের বক্সে ঢুকে কাজটি করেছে, যাকে পুলিশ হয়তো সন্দেহ করেনি।
এর মাধ্যমে আরেকটি বিষয় বের হয়ে আসে। পুলিশের সিপাই থেকে শুরু করে অফিসার পর্যন্ত প্রত্যেকে যদি নিজেদের নিরাপত্তা, বিশেষ করে চলমান জঙ্গি পরিস্থিতি এবং তাদের লক্ষ্য ও কৌশল সম্পর্কে সতর্ক না হন, তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারে। এ ধরনের ঘটনা চট্টগ্রামে এটাই প্রথম। এর আগে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে, পুলিশ বক্স ও পুলিশের গাড়িতে পাঁচটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সেগুলোতেও কেউ নিহত হয়নি, অনেকেই আহত হয়েছেন।
ঢাকার প্রতিটি ঘটনার পরপরই আইএসের (ইসলামিক স্টেট) পক্ষ থেকে কথিত দায়দায়িত্ব স্বীকার করার বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের বেলায়ও তিন দিন পর পূর্বের মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আইএস কর্তৃক দায় স্বীকারের কথা প্রচারিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের ঘটনা এবং তার আগে ঢাকার পাঁচটি ঘটনার চিত্র মোটামুটি একই রকম। টার্গেট পুলিশ বক্স, পুলিশের গাড়ি এবং বিস্ম্ফোরণটি এমনভাবে ও সময়ে ঘটানো হয়, যাতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা না ঘটে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে এসব বোমা আক্রমণের উদ্দেশ্য কী হতে পারে। ঢাকার ঘটনার পর কয়েকজন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বোমা হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য পুলিশ জানতে পেরেছে কিনা জানি না।
তবে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এবং আপাতদৃষ্টিতে বিক্ষিপ্ত ঘটনা মনে হলেও তা মোটেও বিক্ষিপ্ত নয়। এগুলো অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে ঢাকায় এবং এবার চট্টগ্রামে পুলিশকে লক্ষ্য করে যে আক্রমণ, তার অনেক আগে থেকেই পুলিশের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ হয়ে আসছে। ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর মিরপুরে কর্তব্যরত অবস্থায় এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যা করে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা।
মিরপুরের মতো জনাকীর্ণ এলাকায় রাত ৯টায় বগুড়া থেকে আসা একটি আন্তঃজেলা বাস থেকে যাত্রীবেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা আসে এবং পূর্বে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কর্তব্যরত পুলিশ যখন যাত্রীদের তল্লাশি চালাতে শুরু করে, তখন যাত্রীবেশী সন্ত্রাসীরা এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
প্রধান আক্রমণকারী সন্ত্রাসী এনামুল হক কামাল পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তার সঙ্গী মাসুদ রানা ওরফে সুমনকে পুলিশ ধরে ফেলে। ফলে সবকিছু জানা যায়। এনামুল হক কামাল বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি। আরও পেছনের দুয়েকটি উদাহরণ দিই।
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখে হরতাল চলাকালে রাজশাহীতে শিবিরের কর্মীরা দুই পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্রের বাঁট দিয়ে ওই কর্তব্যরত পুলিশকে বেধড়ক পেটায়। তাতে দুই পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরের দিন পুলিশের লুটিয়ে পড়ার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়।
২০০৮ সালের ১১ এপ্রিল শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে ধর্মান্ধ জঙ্গি ও জামায়াত-শিবির একত্র হয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। ওই সময়ের জরুরি আইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার রহস্যজনক কারণে ওই আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী ভয়ংকর তাণ্ডব শুরু করে।
ওই দিন বিকেলে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ চালিয়ে বিশ্রামরত তিন পুলিশকে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী হত্যা করে। তাই আমাদের বুঝতে হবে, পুলিশের ওপর সন্ত্রাসীদের আক্রমণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, জামায়াত-শিবির তো শেষ, তাদের কথা আবার টেনে আনা হচ্ছে কেন। এ রকম যারা ভাবেন তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। আজকে রাজনীতির মাঠে তাদের হয়তো দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু তাদের 'রেজিমেন্টেড' ক্যাডার বাহিনী বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তা ভাবার মতো কোনো কারণ দেখি না। বিগত সময়ে যেসব জঙ্গি-সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে তার প্রায় ৮০ শতাংশ শিবিরের সদস্য। তা ছাড়া অনুসন্ধান এবং গবেষণায় দেখা গেছে, জঙ্গি সংগঠনগুলো বহু নামে ও বহু নেতৃত্বের অধীনে কাজ করলেও এদের সবার শিকড় এক জায়গায়। তারা সবাই ওয়াহাবিতন্ত্রের খেলাফত এবং তাদের ব্যাখ্যামতো শরিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যার উদাহরণ তালেবানি আফগানিস্তান এবং জেনারেল জিয়াউল হকের পাকিস্তান।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার কীভাবে ঘটে, তা নিয়ে দেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে ২০১৬ সালে দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হয়। শুদ্ধস্বরের টুটুলকে হত্যাচেষ্টায় জড়িত জঙ্গি সুমন হোসেন পাটোয়ারী কীভাবে জঙ্গি হয়ে উঠল, তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হয় ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই।
আর ২০১৪ সালের ২৫ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি, ঢাকার উত্তরায় বসবাসরত মুহম্মদ ওমর ওরফে ফয়জুল ওরফে রবি কীভাবে জঙ্গি হলো, তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হয় ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই। এই দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায়- প্রতিটি শহর, উপশহর ও গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত দেশব্যাপী সব শ্রেণি-পেশার যুবকের জঙ্গিবাদের দীক্ষা ও রিক্রুটমেন্টের জন্য একটা ব্যাপকভিত্তিক নেটওয়ার্ক তারা তৈরি করেছে।
একজন যুবক প্রাথমিকভাবে যাদের সংস্পর্শে আসে, তারা দেখা যায় প্রথমভাগে মিলিট্যান্ট বা জিহাদি হওয়ার কথা বলে না। তারা ধর্মের ভালো ভালো কথা দিয়ে শুরু করে। তারপর ধাপে ধাপে নতুন যুবক একজনের কাছ থেকে আরেকজন, তার থেকে অন্যজন, এভাবে হাত বদলাতে বদলাতে একসময় এমন জায়গায় পৌঁছে যায়, সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ থাকে না। এই যে নেটওয়ার্ক সেটা তো বিলুপ্ত হয়নি, যদিও আপাতত তাদের কাজকর্মের স্রোতে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে মনে হয়।
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসানের ঘটনার পর জঙ্গি সংগঠনগুলো, বিশেষ করে জেএমবি বা নব্য জেএমবি এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের সদস্যরা তিন ডজনেরও বেশিবার নতুন করে হামলা চালানোর জন্য বড় ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু র্যাব-পুলিশের সতর্কতা ও তৎপরতায় প্রতিবারই তারা আগেভাগে ধরা পড়েছে এবং গোলাগুলিতে অনেক জঙ্গি আহত-নিহত হয়েছে, অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বহুলাংশে হ্রাস পাওয়ার ফলে জঙ্গি নেটওয়ার্কিং এবং তৎপরতা- দুটির কোনোটাই তারা আগের মতো করতে পারছে না। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিদের প্রেরণা কথিত ইসলামিক স্টেট ইরাক-সিরিয়া থেকে উৎখাত হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই সব দেশের জঙ্গিরা আপাতত কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে গত বছর ঢাকায় পাঁচবার এবং সদ্য চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ ও বিস্ম্ফোরণের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, সেটাই প্রশ্ন। এখানে লক্ষণীয়, এ সময় তারা পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ বা বিস্ম্ফোরণ ঘটালেও তাতে হতাহতের বিষয়টি নিয়ে জঙ্গিরা খুবই সতর্ক।
তারা হয়তো মনে করছে, এ সময় বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালালে সেটা হজম করার মতো রাজনৈতিক ও আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই। অন্যদিকে দেশব্যাপী তাদের যে অনুসারী রয়েছে তাদের মনোবল ধরে রাখার জন্য হলেও কিছুটা তৎপরতা মাঝেমধ্যে দৃশ্যমান করা প্রয়োজন।
আর এ সময় এই আক্রমণগুলো পুলিশের ওপর চালানোর সম্ভাব্য দুটি কারণ রয়েছে। যেহেতু তারা আপাতত বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের দিকে যাচ্ছে না, তাই আক্রমণ বা বোমার বিস্ম্ফোরণ সাধারণ মানুষের ওপর না হয়ে পুলিশের ওপর হলে দেশে ও বিদেশে মিডিয়া কভারেজ ভালো পাওয়া যাবে।
তারা যে এখনও আছে- এই খবরটি দেশ ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। দ্বিতীয় কারণ, পুলিশের ওপর তাদের ক্ষোভ তো বহু পূর্ব থেকেই রয়েছে। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের সঙ্গে পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া- জঙ্গিরা ইচ্ছা করলে তাদের ওপর বহুবিধ পন্থায় আক্রমণ চালিয়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সাধনের সক্ষমতা রাখে।
এক প্রকার হুমকি ও ভয় দেখানো। তাই আত্মতুষ্টিতে না থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতাসহ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা সর্বদা অব্যাহত রাখতে হবে। এটা স্পষ্ট, আপাতত জঙ্গিরা লো-প্রোফাইলে থাকলেও বসে নেই। শুধু রাজনৈতিক ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার জায়গাটি একটু শক্ত হলেই তারা পূর্বের মতো টার্গেট কিলিং এবং অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করবে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।