ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

জন্মদিনের উপহারের লোভ ঘুমুতে দিতো না হুমায়ূনকে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৪৯, ১৩ নভেম্বর ২০১৭

Ekushey Television Ltd.

প্রতিটি মানুষের ছেলেবেলা আছে। হোক সে বিখ্যাত বা অখ্যাত। বিশেষ করে বিখ্যাত বা প্রতিথযশা মানুষদের জীবনী সম্পর্কে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। তেমনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলা নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই পাঠকের।

ছেলাবেলার স্মৃতি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই লিখে গেছেন ‘আমার ছেলেবেলা’ নামক বইটি। এ বইটির মাধ্যমেই জানা যায় তার ও তার ভাই-বোনদের ছেলেবেলা। তার প্রথম জন্মদিন উদযাপনের কাহিনী। জানা যায় তার ছেলেবেলার ছোট ছোট অনুভূতির কথা।

১৯৪৮ সালের এ দিনে সবার প্রিয় এ লেখক জন্ম নিয়েছিলেন। তার জন্মদিনকে ঘিরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা আয়োজন করেছে। তার জন্মদিন পালনের বেশ আগ্রহ ছিলো। প্রথমবারের মতো জন্মদিন উযদাপন করা হয় তার আগ্রহেই।

পারুল নামে একজনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ছোটবেলায় সখ্য গড়ে উঠে। তারা তাদের প্রতিবেশি ছিল। কিন্তু একদিন ওই প্রতিবেশীরা অন্য জায়গায় চলে যান। এ নিয়ে মন খারাপ হয়ে যায় তার।

আমার ছেলেবেলায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন-

পারুল আপা নেই, কাজেই স্কুলের দুঃসহ দুঘণ্টা কোনোক্রমে পার করে দেবার পরের সময়টা মহানন্দের। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‌‌‌‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’। সাজানো গোছানো সুন্দর বাড়ি দেখলেই হুট করে ঢুকে পড়ি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তৎক্ষণাৎ বের করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি বাড়িতে ভিন্ন ব্যাপার হল। এই বাড়িটিও মীরাবাজারেই। আমাদের বাসার কাছে। বিশাল কম্পাউন্ড, গাছগাছালিতে ছাওয়া ধবধবে সাদা রঙের বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। এই বাড়িতে কে থাকনে তাও আমরা জানি, সিলেট এম. সি. কলেজের অধ্যাপক।

আমাদের কাছে তাঁর পরিচয় হচ্ছে প্রফেসর সাব, অতি অতি অতি জ্ঞানী লোক-যাঁকে দূর থেকে দেখলেই পূণ্য হয়। তবে এই প্রফেসর সাহেব নাকি পাকিস্তানে থাকবেন না, দেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যাবেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নাকি চাকরিও হয়েছে। তিনি চেষ্টা করছেন বাড়ি বিক্রির।

এক দুপুরে গেট খোলা পেয়ে হুট করে সেই বাড়ির ঢুকে পড়লাম। গাছপালার কী শান্ত শান্ত ভাব। মনে হয় ভুল করে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি এক বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়েছি। আনন্দে মন ভরে গেল। একা একা অনেক্ষণ হাঁটলাম। হঠাৎ দেখি কোনোর দিকের একটি গাছের নিচে পাটি পেতে একটি মেয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার হাতে একটা বই। সে বই পড়ছে না- তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি আমার জীবনে এত সুন্দর মেয়ে আর দেখিনি। মনে হলো তার শরীর সাদা মোমের তৈরি। পিঠভরতি ঘন কালো চুল। ষোলো-সতেরো বছর বয়স। দৈত্যের হাতে বন্দিনী রাজকন্যারাও এত সুন্দর হয় না। মেয়েটি হাত-ইশারায় ডাকল। প্রথমে ভাবলাম দৌড়ে পালিয়ে যাই। পর মুহূর্তেই সেই ভাবনা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে গেলাম।

কী নাম তোমার খোকা?

কাজল।

কী সুন্দর নাম!কাজল। তোমাকে মাখতে হয় চোখে। তা-ই না?

কিছু না বুঝেই আমি মাথা নাড়লাম।

অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছি, তুমি একা একা হাঁটছ। কী ব্যাপার?

আমি চুপ করে রইলাম।

কী জন্য এসেছ এ বাড়িতে?

বেড়াতে।

ও আচ্ছা- বেড়াতে? তুমি তাহলে অতিথি। অতিথি নারায়ণ। তা-ই না?

আবার না বুঝে আমি মাথা নাড়লাম। সে বলল, তুমি এখানে চুপচাপ দাঁড়াও। নড়বে না। আমি আসছি।

মেয়েটি চলে গেল। ভেবে পেলাম না সে অনধিকার প্রবেশের জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা করতে গেল কি না। দাঁড়িয়ে থাকাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে? পালিয়ে যাওয়াই উচিত। অথচ পালাতে পারছি না।

মেয়েটি ফিরে এসে বলল, চোখ বন্ধ করে হাত পাতো।

আমি তা-ই করলাম। কী যেন দেয়া হল আমার হাতে। তাকিয়ে দেখি কদমফুলের মতো দেখতে একটা মিষ্টি।

খাও, মিষ্টি খাও। মিষ্টি খেয়ে চলে যাও। আমি এখন পড়াশোনা করছি। পড়াশোনার সময় কেউ হাঁটাহাঁটি করলে বড় বিরক্তি লাগে। মন বসাতে পারি না।

 

আমি চলে এলাম এবং দ্বিতীয় দিনে আবার উপস্থিত হলাম।

আবার মেয়েটি মিষ্টি এনে দিল। কোনো সৌভাগ্যই একা একা ভোগ করা যায় না। আমি তৃতীয় দিনে আমার ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত। মেয়েটি মিস্মিত হয়ে বলল, এ কে?

আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, এ আমার ছোট বোন। এ-ও মিষ্টি খুব পছন্দ করে।

মেয়েটির মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। সে হাসতে হাসতে বলল, খুকি, তোমার নাম কী?

 আমার বোন উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকাল। নাম বলাটা ঠিক হবে কি না সে বুঝতে পারছে না। আমি ইশারায় তাকে অভয় দিতেই সে বলল, আমার নাম শেফু।

শেফু? অর্থাৎ শেফালি। কী সুন্দর নাম! তোমরা দু’জন চোখ বন্ধ করে দাঁডিয়ে থাকো।

আমরা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। এক সময় চোখ মেললাম। মেয়েটি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ বিষন্ন। সে দুঃখিত গলায় বলল, আজ ঘরে কোনো মিষ্টি নেই। তোমাদের জন্য একটি বই নিয়ে এসেছি। খুব ভালো বই। বইটা নিয়ে যাও। দাঁড়াও, আমার নাম লেখে দিই।

সে মুক্তার মতো হরফে লিখল, দু’জন দেবশিশুকে ভালোবাসা ও আদরে-

শুক্লাদি।

বই নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বইটার নাম ‌ক্ষীরের পুতুল। লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাতায় পাতায় ছবি।

তিনি ওই বইয়ের পদ্মপাতার জল নামক অংশে লিখেছেন-

আমাদের পাশের বাসায় থাকত নাদু দিলুরা।

তারাও আমাদের মতোই অল্প আয়ের বাবা-মা’র পুত্র-কন্যা। সবাই একসঙ্গে ধুলোমাটিতে গড়াগড়ি করে বড় হচ্ছি। ওমা! একদিন শুনি ওরা বড়লোক হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ওদের কাপড়চোপড় পাল্টে গেল। কথাবার্তার ধরন-ধারণও বদলে গেল। এখন আর ওরা দাঁড়িয়াবান্দা কিংবা ছি-বুড়ি খেলার জন্যে আমাদের কাছে আসে না।

ঈদ উপলক্ষে ওরা নতুন কাপড় তো পেলই, সেই সঙ্গে ট্রাই সাইকেল। ট্রাই সাইকেলটি শিশুমহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। আমিও এর আগে এই জিনিস দেখিনি। কী চমৎকার ছোট্ট একটা রিকশা। এর মধ্যে আবার বেলও আছে। টুং টুং করে বাজে। এই বিস্ময়কর বাহনটিতে একবার শুধু চড়তে পারার দুর্লভ সৌভাগ্যের জন্যে আমি তখন আমার সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দিতে পারি। চেষ্টা করে বিফল হলাম। সব সময় নাদু দিলুর সঙ্গে একজন কাজের মেয়ে থাকে। আমি কাছে গেলেই সে খ্যাঁক করে ওঠে। হাত দিয়ে একটু দেখার অনুমতি চাইলাম, সেই অনুমতিও পাওয়া গেল না। আমরা শিশুরা সমস্ত কাজ-কর্ম ভুলে ট্রাই সাইকেল ঘিরে গোল হয়ে বসে রইলাম। অনেক চিন্তা করে দেখলাম ট্রাই সাইকেল কেনার কথা বাবাকে কি বলা যায়? মনে হলো সেটা ঠিক হবে না। বাবার তখন চরম আর্থিক সমস্যা যাচ্ছে। তাঁর সবচেয়ে আদরের ছোট বোন অসুস্থ। সেই বোনের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার তাঁর বহন করতে হচ্ছে। ঈদে আমরা ভাই-বোনেরা কোনো কাপড়চোপড় পাইনি। শেষ মুহূর্তে বাবা আমাদের তিন ভাইবোনকে তিনটা প্লাস্টিকের চশমা কিনে দিলেন, যা চোখে দিলে আশপাশের জগৎ নীল বর্ণ ধারণ করে। কাপড় না পাওয়ার দুঃখ রঙিন চশমায় ভুললাম। তার চেয়েও বড় কথা, দিলু এই চশমার বিনিময়ে আমাকে তার ট্রাই সাইকেল খানিকটা স্পর্শ করার দুর্লভ সুযোগ দিল। সে বড়ই আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

যতই দিন যেতে লাগল, এদের রমরমা সমসমা বাড়তেই লাগল। শুনলাম তাদের জন্যে বিশাল দোতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কোনো রকম কষ্টে-সৃষ্টে এখানেই থাকবে। এর মধ্যে এ দুই ভাইবোনের জন্মদিন হলো। জন্মদিন বলে যে একটা ব্যাপার আছে আমার জানা ছিল না। এই দিনে উৎসব হয়। খানাদানা হয়। উপহার নিয়ে লোকজন আসে কে জানত। আমরা অভিভূত।

শেফু একদিন বাবাকে গিয়ে বলল, আমার জন্মদিন করতে হবে।

বাবা খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে মা, করা হবে। কিন্তু শুধুই একবার। এই উৎসব আমি দ্বিতীয়বার করব না। তোমরা বড় হওয়ার চেষ্টা করো। অনেক বড়, যাতে সারা দেশের মানুষ তোমাদের জন্মদিনের উৎসব করে। বাবা-মা’র করতে না হয়।

শেফু বলল, সে প্রাণপণ চেষ্টা করবে বড় হওয়ার।

আমি দেখলাম সুযোগ ফসকে যাচ্ছে। শুধু শেফুর জন্মদিন হবে আমার হবে না, এ কেমন কথা! আমি গম্ভীর গলায় বললাম, বাবা আমিও খুব বড় হওয়ার চেষ্টা করব। আমারও জন্মদিন করতে হবে। বাবা বললেন, আচ্ছা তোমারও হবে।

শুধু ইকবাল ঘোষণা করল সে বড় হতে চায় না। ছোটই থাকতে চায়। তার জন্মদিন লাগবে না।

আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। নভেম্বরের ৯ তারিখ শেফুর জন্মদিন। দেখতে দেখতে ৯ তারিখ এসে পড়ল। আমরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ করলাম এ উপলক্ষে কাউকে বলা হলো না। বাবা বললেন, আমরা নিজেরা নিজেরা উৎসব করব। কাউকে বলব না।

পায়েস ছাড়া অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য তৈরি হলো না। আমাদের মন ভেঙে গেল। সন্ধ্যার পর জন্মদিনের উৎসব শুরু হলো। বাবা ‘বীর পুরুষ’ কবিতা আবৃত্তি করলেন। প্রাণেশ কাকু তিনটা গান গাইলেন। পায়েস খাওয়া হলো। তারপর বাবা ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিয়ে শেফুর হাতে একটা উপহারের প্যাকেট তুলে দিলেন। সেই উপহার দেখে আমাদের সবার বিস্ময়ে বাকরোধ হয়ে গেল। আমার দরিদ্র বাবা খুবই দামি উপহার কিনেছেন। চীনেমাটির চমৎকার খেলনা ‘টি সেট’, যা দেখলে একালের শিশুদেরও চোখ কপালে উঠে যাওয়ার কথা।

বাবা বললেন, পছন্দ হয়েছে মা?

শেফু কাঁদতে কাঁদতে বলল, এত সুন্দর জিনিস সে তার জীবনে দেখেনি। আনন্দে সারারাত সে ঘুমাতে পারল না। বারবার বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখে আসে টি সেট ঠিকঠাক আছে কি না। সেই রাতে আমি নিজেও উদ্বেগে ঘুমুতে পারলাম না। আর মাত্র তিন দিন পর আমার জন্মদিন। না জানি কী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। গোপন সূত্রে খবর পেলাম, আমার জন্যে দশগুণ ভালো উপহার অপেক্ষা করছে। খবর দিলেন মা। মা’র খবর খুবই নির্ভরযোগ্য।

জন্মদিন এসে গেল। গান, কবিতা আবৃত্তির পালা শেষ হওয়ার পর আমার হাতে উপহারের প্যাকেট তুলে দেওয়া হলো। প্যাকেট খুলে দেখি একটা বাঁধানো ফ্রেমে দীর্ঘ একটি কবিতা। বাবা ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছেন। কবিতার প্রথম দুটি চরণ—

সাতটি বছর গেল পরপর আজিকে পড়েছো আটে

তব জন্মদিন নয়তো মলিন ভয়াল বিশ্ব হাটে...

বাবা খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, উপহার পছন্দ হয়েছে? অনেক কষ্টে কান্না চাপা দিয়ে বললাম—হ্যাঁ।

তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে পছন্দ হয় নাই।

আমি চুপ করে রইলাম।

বাবা খানিকক্ষণ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এই উপহার এখন তোর কাছে সামান্য মনে হচ্ছে। এমন একদিন আসবে, যখন আর সামান্য মনে হবে না।

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি