জমজম কূপের পানির রহস্য কথা
প্রকাশিত : ১৫:৩৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৫:৫৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০
জমজম কূপ। মক্কার মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ কূপ। পবিত্র কাবা ও এই কূপের মধ্যে দূরত্ব হলো মাত্র ৩৮ গজের। এই কূপের কাছে একটি শক্তিশালী পাম্পিং মেশিন বসানো হয়েছে। সে মেশিনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে একটি প্রশস্ত জায়গায় নিক্ষেপ করা হয়। সেখান থেকে লাখ লাখ মানুষ তৃপ্তিভরে পানি পান করে এবং পাত্রে ভরে নিয়ে যায়। হেরেম শরিফের বিভিন্ন জায়গায় পাইপলাইনের মাধ্যমেও জমজমের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে।
আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে ইবরাহিম (আ.) প্রিয়তমা স্ত্রী হাজেরা এবং শিশুপুত্র ইসমাঈলকে মক্কার ফারান পাহাড়ের পাদদেশে বালুময় বিরান প্রান্তরে নির্বাসন দেন আল্লাহর নির্দেশে। অসহায় স্ত্রী পেছন থেকে বারবার কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এ জনমানবহীন প্রান্তরে আমাদের একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন? ইবরাহিম (আ.) নির্বিকার। কোনো উত্তর নেই।
অবশেষে স্ত্রী বললেন, ‘আপনি কি আল্লাহর কোনো নির্দেশ পেয়েছেন?’ মাথা নেড়ে শুধু বললেন, ‘হ্যাঁ’। আল্লাহর নির্দেশের কথা জানতে পেরে হজরত হাজেরা (আ.) খুশি মনে বললেন, তাহলে তিনি আমাদের ধ্বংস হতে দেবেন না। মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা নিয়ে ধূসর, রুক্ষ, ধূলির রাজ্যে একাকী জীবন শুরু করেন বিবি হাজেরা (আ.)। একদিন নিদারুণ পিপাসা তাকে পানি তালাশে বাধ্য করল। তিনি শিশু ইসমাঈলকে উন্মুক্ত স্থানে রেখে ‘সাফা-মারওয়া’ পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। দৌড়াদৌড়ির এক পর্যায়ে তিনি শুনতে পান, কে যেন আওয়াজ করছে। হাজেরা (আ.) বললেন, ‘তুমি যদি সাহায্য করতে পার, তবে সামনে আস।’ অতঃপর জিবরাঈল (আ.) পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেন।
মুসলমানদের কাছে জমজমের পানি অতি বরকতময় ও পবিত্র। হাদিসে এ পানির অশেষ কল্যাণ ও বরকতের কথা উল্লেখ রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও কল্যাণকর পানি জমজমের পানি। এ পানি ক্ষুধার্তের জন্য খাদ্য এবং রোগীর জন্য শেফাস্বরূপ।’ (ইবনে মাজাহ) বিদায় হজের সফরে রাসুল (সা.) জমজমের পানি খুব বেশি পরিমাণে পান করেছেন, চোখে দিয়েছেন এবং মাথায় ঢেলেছেন। ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়া নামক স্থানে অবস্থানকালে রাসুল (সা.) মক্কা থেকে জমজমের পানি আনিয়ে পান করেন এবং সঙ্গে করে মদিনায় নিয়ে আসেন।
আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয়নবী (সা.) কোথাও গেলে সঙ্গে জমজমের পানি নিয়ে যেতেন এবং রোগীদের ওপর এ পানি ছিটিয়ে দিতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জমজমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হবে তাই হাসিল হবে।’ সাহাবারা জমজমের পানি অত্যন্ত তাজিমের সঙ্গে পান করতেন এবং সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। এ নিয়ম এখনও চালু রয়েছে।
পবিত্রতা ও বৈশিষ্ট্যে জমজম কূপের পানি পৃথিবীর সকল পানির চেয়ে উত্তম। কাবা ঘরের ফজিলতের সঙ্গে জমজম কূপের মাহাত্ম্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাবাঘরের ইতিহাস ও জমজম কূপ একের সঙ্গে অন্যটি গুরুত্বপূর্ণভাবে জড়িত। জমজম নবী ইব্রাহিম (আ.) এর ছেলে নবী ইসমাঈল (আ.) এর স্মৃতিবিজড়িত কূপ। জমজম কূপের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১. পৃথিবীর যে কোনো কূপের পানি দীর্ঘদিন আবদ্ধ থাকার ফলে তার রঙ ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু হাজার হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও জমজমের পানির রঙ ও স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
২. জমজম কূপের পানি মাটি থেকে প্রায় ১০.৬ ফুট নিচে। সেখান থেকে শক্তিশালী মোটরের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ৮ হাজার লিটার হারে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পানি উত্তোলন করা হয়। আর তখন পানির স্তর নেমে যায় ৪৪ ফুট নিচে। কিন্তু পানি উঠানো বন্ধের মাত্র ১১ মিনিটে আবার পানির লেভেল চলে আসে ১৩ ফুটে। নিশ্চয়ই এটা অবাক হওয়ার মতো বিষয়।
৩. কোনো নদী বা জলাশয়ের সঙ্গে জমজম কূপের যুগসূত্র নেই। অথচ সবসময় এই কূপ থেকে লাখ লাখ মানুষ পানি সরবরাহ করছে। কখনও শুকিয়ে যায় না।
৪. জমজমের পানি শুধু তৃষ্ণা মেটায় না। বরং ক্ষুধাও নিবারণ করে এবং আরোগ্য দান করে।
৫. জমজমের পানি দাঁড়িয়ে কেবলামুখী হয়ে পান করা মুস্তাহাব এবং এ পানি দ্বারা শৌচ করা মাকরুহ।
জমজমের পানি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। সৌদি আরবে জিওলজিক্যাল সার্ভের রয়েছে ‘জমজম স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ নামে একটি গবেষণাকেন্দ্র।
ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সাধারণ পানির তুলনায় জমজমের পানিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম সল্টের পরিমাণ বেশি, যা ক্লান্তি দূর করতে বিরাট ভূমিকা রাখে। জমজমের পানিতে যেসব উপাদান রয়েছে তা মানুষের খাদ্য, পুষ্টি ও রোগ নিরাময়কারী। ব্রিটিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের উদ্যোগে জমজমের পানি নিয়ে গবেষণা করা হয়। ওই গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, জমজমের পানি স্বাস্থ্যের জন্য উৎকৃষ্ট টনিকস্বরূপ।
এক মিসরীয় ডাক্তার জমজমের পানি সম্পর্কে গবেষণা করে যে রিপোর্ট তৈরি করেছেন তা হলো- এ পানিতে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, পটাসিয়াম নাইট্টিট এবং হাইড্রোজেন। ১৯৭৭ সালে লিবিয়ার ত্রিপলির একটি টিম জমজমের পানি সম্পর্কে গবেষণা করে দেখেছে, এতে রয়েছে টোটাল ডিজলভড সলিড ১৬২০, ক্লোরিল ২৩৪, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ৩৬৫, সালফেট ১৯০, ক্যালসিয়াম + ভি-ই, ম্যাগনেসিয়াম + ভি-ই, আয়রন, সালফার ভি-ই, নাইট্রোটস ভি-ই।
সম্প্রতি জাপানের এক গবেষক ‘মাসরু এমোটো’ জমজমের পানি গবেষণা করে বলেছেন, জমজমের এক ফোঁটা পানির যে নিজস্ব খনিজ গুণাগুণ আছে, তা পৃথিবীর অন্য কোনো পানির নেই।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ পানির ১ হাজার ফোঁটার সঙ্গে যদি জমজমের পানির এক ফোঁটা মেশানো হয়, তাহলে সেই মিশ্রণও জমজমের পানির মতো বিশুদ্ধ হয়। কেননা জমজমের পানির মতো বিশুদ্ধ পানি পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে জমজমের পানি আল্লাহপাকের কুদরতের এক জীবন্ত মোজেজা। এ পানি নিয়ে যত গবেষণা হবে, তা হবে খুবই অপ্রতুল।
এছাড়া কোরআন হাদীসের আলোকে জমজমের পানি পানের বেশ কিছু ফজিলত পাওয়া যায়।
হজরত আবু জর (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি বরকতময়, স্বাদ অন্বেষণকারীর খাদ্য।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৭৩)
মুসনাদে তায়ালুসিতে এই হাদিসের একটি বর্ধিত অংশ উদ্ধৃত হয়েছে, ‘এবং রোগীর ওষুধ।’ আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের সঙ্গে পাত্রে ও মশকে করে জমজমের পানি বহন করতেন। তা অসুস্থদের ওপর ছিটিয়ে দিতেন এবং তাদের পান করাতেন। (সুনানে তিরমিজি)।