ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

জহির রায়হানকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে : অনল

প্রকাশিত : ১৬:০৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং ঔপন্যাসিক জহির রায়হান। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এমনকি ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।

দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসেন জহির রায়হান। দেশ স্বাধীন হলেও মিরপুর ছিল বিহারী অধ্যুষিত এলাকা, যেখানে বিহারীরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যরা বাস করতো। তাদের এদেশ থেকে হটাতে জহির রায়হানসহ কিছু বাংলাদেশি সেনারা সেখানে যান।

বিহারী অধ্যুষিত এলাকায় পৌঁছালে তারা গুলি চালায়। তাদের গুলিতে শহীদ হন জহির রায়হান। কথাগুলো বলছিলেন শহীদ জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অনল রায়হান আরও বলেন, তার বাবা নিখোঁজ বা হারিয়ে যাননি। ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সেনারা তাকে শহীদ করেন। অনেকেই তার সর্ম্পকে জানে না। যে কারণ দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে জহির রায়হানকে তুলে ধরতে হবে। একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সঠিক ইতিহাস জানতে কাজ সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

এছাড়া পাঠ্যবইয়ে নতুন করে জহির রায়হানের সঠিক ইতিহাস সংযুক্ত করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে তিনি দেশের জন্য কি করেছেন। তুলে ধরতে হবে বিশ্ববাসীর কাছে।

শুধু বুদ্ধিজীবী দিবস কিংবা বিজয় দিবস আসলেই এদেরকে স্মরণ করলেই চলবে না। বছরজুড়ে তাদেরকে নিয়ে রিসার্স করতে হবে। তাদের আর্দশকে হৃদয়ে লালন করতে হবে। কিন্তু এই কাজগুলো করতে সরকার, রাষ্ট্র এমন কি আমাদের দেশের সুশীল সমাজ আজ ব্যর্থ।

বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে সরকার কি ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে অনল রায়হান বলেন, সরকার পাঠ্যবইতে নতুন করে জহির রায়হান ইতিহাস সংযুক্ত করতে পারে। এছাড়া যারা দেশে রক্ষায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নামে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করতে পারে। বুদ্ধিজীবীদেব নিয়ে গবেষণামুলক কিছু একটা করতে পারে।

এ বিষয়গুলোতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু সরকার নয় বেসরকারি সংস্থাগুলোকেই একযোগ কাজ করতে হবে।

এ কাজগুলো করতে আমরা খুবই ব্যর্থ, যে শুধু বুদ্ধিজীবী দিবস কিংবা বিজয় দিবস আসলে আমরা সভা, সেমিনার, টক শো করি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে। দিবস শেষ জহির রায়হানসহ বুদ্ধিজীবীর ‍নিয়ে আলোচনা শেষ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধার সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে।

বাবাকে নিয়ে স্মৃতির বিষয়ে অনল রায়হান বলেন, মিরপুর ১২ নম্বরের ডি ব্লকের যাওয়ার পথেই পড়ে মুসলিম বাজার। পাশেই একটা মসজিদ। ১৯৯৯ সালে মসজিদটা নতুন করে নির্মাণ করতে গিয়ে হঠাৎ করেই এক্সিডেন্টলি শ্রমিকরা আবিষ্কার করে মাটির সামান্য নিচে কংক্রিটের স্লাব দিয়ে মুড়ে দেওয়া একটা কুয়ো। যার মুখটা ভাঙ্গতেই পাওয়া যায় তিনটা খুলি ও বেশ কিছু কাপড় চোপড়। ভয় পেয়ে শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে সে রাতেই মসজিদ কমিটির সভাপতির হস্তক্ষেপে মসজিদের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে ট্রাকে করে মাটি ফেলে জায়গাটা সমান করে দেওয়া হয়। কিন্তু সত্য আর কতদিন চাপা থাকে।

আমি খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে নিজে শনাক্ত দেখি আমার বাবার পোশাক, হাড়, খুলি, স্লাবটা খোঁড়ার পরেই বেরিয়ে এসেছিল। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বিহারী ও পাকিস্তানিদের চালানো সেই হত্যাকাণ্ডে জীবিত একমাত্র সেনা সদস্য আমির হোসেনকে, যিনি সাক্ষ্য দেন, কালো প্যান্ট, সাদা জামা ও হলুদ সোয়েটার পরা যে সাংবাদিক ছিলেন তাদের সঙ্গে, চোখের সামনে তাকে প্রথমে ব্রাশফায়ার ও পরে কোপাতে কোপাতে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যায় বিহারীরা। এমনকি সেই যে রাতারাতি মাটি ফেলে পাকিস্তানী-বিহারী ভাইদের পৈশাচিক গণহত্যার প্রমাণ মুছে ফেলতে চেয়েছিল মসজিদ কমিটি।

২০০১ সালে বিএনপির সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই পুর্নোদ্যমে তড়িঘড়ি করে বধ্যভূমির পুরো জায়গাটি সমেত মুসলিম বাজারের একটা বিশাল অংশজুড়ে মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়ে ফেলে তারা। উদ্দেশ্য ধর্মভীরু বাঙালির ধর্মানূভূতি কাজে লাগিয়ে পূর্বপুরুষের বর্বরতার চিহ্ন মুছে ফেলা।

শহীদদের স্মরণে কোন স্মৃতিস্তম্ভ তো দূরে থাক, তারা যত্নের সঙ্গে পরিষ্কার করে ফেলে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম প্রমাণগুলোও। শেষ পর্যন্ত আর কোনো উপায়ন্তর না দেখে মসজিদের ভেতরের তিনটা পিলারের রং কালো করে দেওয়া হয় রাজমিস্ত্রিকে ধরে। বধ্যভূমির সব নাম-নিশানা মুছে ফেললেও কেউ যেন কিছু না বলতে পারে,সেটা নিশ্চিত করতে মসজিদের নাম দেওয়া হয়, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জামে মসজিদ।

আজকে সবাই শুধু জানে এইখানে একটা মসজিদ আছে, কিন্তু এই মসজিদটা যে ২০-২৫ হাজার নিরপরাধ মানুষের বধ্যভূমি, সেটা কেউ জানে না। জানার কোনো উপায় নাই। এমনকি কোনো চিহ্নও রাখেনি।

আর শহীদদের দেহাবশেষে ভরে থাকা মসজিদের পেছনের সেই কূপ আর ডোবার উপর এখন মসজিদের টয়লেট। বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক, ঔপন্যাসিকের দেহাবশেষ যেখানে পড়ে ছিল, সেই জায়গাটার ওপর প্রতিদিন মলমূত্র ত্যাগ করে যায় হাজারো আদম সন্তান। আমি সরকারের কাছে আবেদন করছি যে সরকার যে এই স্থানটিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে। আমি কিন্তু কোনো স্মৃতির মিনার করতে বলছি না।

প্রসঙ্গত, জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সঙ্গে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি করেন।

জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেন। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পন ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাবেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন।

১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।

 

টিআর / এআর

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি