ঢাকা, বুধবার   ০২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

জাতির পিতা

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী

প্রকাশিত : ০৮:৫০, ২ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১৪:৪৫, ২ আগস্ট ২০২১

Ekushey Television Ltd.

আমরা বাঙালিরা সব সময়ই চেষ্টা করেছি আমাদের স্বীয় জাতিসত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন জীবন যাপনের। কিন্তু বাঙালি জাতি তথা এ অঞ্চল সব সময় কোনো না কোন বহিঃশক্তি দ্বারা শোষিত ছিল। যতবার এ অঞ্চল তথা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার ওপর হুমকি এসেছে ততবার বাঙালিরাই সর্বপ্রথম গর্জে উঠেছে। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে বাঙালিরাই। 

পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার মাধ্যমে এ অঞ্চলে যে ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার সূচনা হয়েছিল, সেই স্বাধীনতার সূর্যও বাঙালিরাই নেতৃত্ব দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে। সেসব বীর বাঙালিরা শুধু সংগ্রামই করেননি বরং অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর জীবনের বিনিময়ে পুনরুদ্ধার করেছে যে স্বাধীনতা, সেখানেও নেতৃত্ব দিয়েছে সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, সুভাষ বোস, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, চিত্তরঞ্জন, বীনা রায়ের মতো সাহসী আর ক্ষণজন্মা বাঙালিরা। 

বাঙালির অধিকার আদায় আর পৃথক জাতিসত্তাকে তুলে ধরেছেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মহান রাজনীতিবিদরা।

বাঙালির অধিকার আদায়ে দৃশ্যপটে এক মাহেন্দ্রক্ষণে আবির্ভাব ঘটে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ইংরেজদের ২০০ বছরের শোষণ শেষে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান স্বাধীনতার নামে নতুন করে শুরু করে বাঙালি শোষণ। ব্রিটিশদের পরিবর্তে শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পাকিস্তানিরা।

বাঙালি-অধ্যুষিত এ অঞ্চলে পাকিস্তানি শাসন জন্ম দেয় আরেকটি নব্য উপনিবেশের। বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাঙালিরা কখনই পাকিস্তানিদের শাসনে নিরাপদ নয়। তাই পাকিস্তান সৃষ্টির পর পৃথক বাঙালি রাষ্ট্রের চিন্তা সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর মাথা থেকেই আসে। ছাত্রাবস্থায়ই একটা সাইকেল আর কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে তিনি বের হয়ে পড়েন।

যুবসমাজ, ছাত্রসমাজকে তিনি বোঝাতে থাকেন বাঙালির স্বকীয়তার কথা, স্বাধিকারের কথা। তরুণ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান। জেলায় জেলায় ঘুরে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করতে থাকেন। এভাবেই জন্ম নেয় একটি সংগঠনের, যার নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এই ছাত্রলীগকে সঙ্গে নিয়েই তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন এক স্বাধীন বাংলাদেশের। বাঙালি জাতির জন্য স্বপ্ন দেখেই তিনি ১৪ বার জেলে যান আর দু’বার তাকে নেয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। 

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। তারা আমাদের রক্তের বিনিময়ে যে ভাষার অধিকার দিয়েছেন সেই ঋণ কোনদিন শোধযোগ্য নয়। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের পাশাপাশি আমরা একটি নাম বার বারই ভুলে যাই, আর সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নাম। কারণ, ভাষা আন্দোলন শুরু থেকে সে আন্দোলনকে আরও বেগবান করার মাধ্যমে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের সংগ্রামে যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনে গঠিত ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভায়ও সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু।

সুদূর অতীতের ধর্ম ও ইতিহাসের অনেক করুণ কাহিনী নিয়ে আমরা চোখের জল ফেলি, কিন্তু আমাদের বুকের ওপর ঘটে যাওয়া পনের আগস্টের ঘটনায় কখনই আমরা বিচলিত বা উদ্বিগ্ন হই না। বরং সেই ঘটনার পক্ষে অবস্থান নেয়ার বিকৃত মানসিকতাও দেখা যায়। যিনি একটি জাতি, একটি দেশ, একটি পতাকা উপহার দিলেন, মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠিত করলেন তাকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি কখনই মেনে নেয়নি, বরং তাকে হত্যার মাধ্যমে সেই পরাজয়ের যন্ত্রণা ভুলতে চেয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু আন্দোলন-সংগ্রামেই নেতৃত্ব দিয়ে এ জাতির জন্ম দেননি। তিনি এ দেশকে, এ জাতিকে পিতৃস্নেহে আগলে রেখেছেন। তাই তো তিনি জাতির জনক। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের খুঁজে এনে তাদের পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’। এই বোর্ডের পরিচালকদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। 

একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক পিতাসহ একটি মেয়েকে নিয়ে রাত আড়াইটায় আমার কাছে ছুটে আসেন। মেয়েটি মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের একজন। তার অবস্থা তখন ছিল খুবই নাজুক। আমি তাকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম নির্যাতিত নারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এক বিশেষ হাসপাতালে। তার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, ডাক্তাররা ঝুঁকি মনে করে তার চিকিৎসা শুরুর পূর্বে মেয়েটির নাম, ঠিকানা, পিতৃ-পরিচয় জানতে চান। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল, এসব বীরাঙ্গনাদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না, এহেন পরিস্থিতিতে আমি তার জীবন বাঁচানোর স্বার্থে সাহায্যের জন্য সূর্যোদয়ের পূর্বেই ৩২ নম্বরের বাড়িতে যাই। বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি-ফতুয়া পরা, চটি পায়ে, পাইপ হাতে বের হয়ে আসেন। হঠাৎ আমাকে দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে আমার আসার কারণ জানতে চান। 

আমি সব কিছু খুলে বলি- পিতার নাম-ঠিকানা ছাড়া ডাক্তাররা মেয়েটির চিকিৎসা করবে না, আর সেটা দেয়াও সম্ভব না। বঙ্গবন্ধু ক্ষণকাল চুপ করে থেকে অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন, ‘গিয়ে বল, ওর বাবার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিকানা : রোড নং-৩২, ধানমণ্ডি।’ আজ যতবারই মনে হয়, কেবলই একটা কথাই চিন্তায় আসে যে, পিতা সত্যিই জাতির পিতা। এ দেশের প্রতিটি মানুষকে যে সন্তান মনে করত। 

ভারত-পাকিস্তান দাঙ্গার পর এ ধরনের নির্যাতিত মেয়েদের জন্য পৃথক ‘হোম’ তৈরি করে তালিকা প্রণয়ন করে তাদের সামাজিক পৃথক পরিচয় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতায় মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে এমন বিব্রতকর পরিচয় সৃষ্টি হয়নি- তারা যে বীরাঙ্গনা। 

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে বিমান বন্দরে নেমে বলেছিলেন, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি সেই রক্তের ঋণ আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও শোধ করব। তিনি সেই ঋণ শুধু নিজের জীবন দিয়েই শোধ করেননি, বরং তার নিজের পরিবারের জীবনের বিনিময়ে সেই ঋণ শোধ করেছেন আর আমাদের ঋণী করে গেছেন।

পিতা তুমি মহান। আগস্টের এই দিনে আমরা তোমায় স্মরণ করি। কবিগুরুর ভাষায় বলতে চাই, ‘নয়ন-সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’

(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেয়া)

লেখক: সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রমিলা রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে দায়িত্ব পালন করেন।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি