ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

জাতির শিরদাঁড়া ভাঙ্গতেই তাঁদেরকে হত্যা করা হয়

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ১২:৫০, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই মহান এ জাতিকে পঙ্গু করার এক অপচেষ্টা করে যায় পাকিস্তানি সেনারা। বাঙ্গালিদের বিজয় অভিসম্ভাবী বুঝতে পেরে স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে এক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তারা। জাতিকে চিরতরে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করে দেওয়ার লক্ষ্যে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, আইনজীবী ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয়।

স্বশস্ত্র সংগ্রামের শেষ মুহূর্তে বাড়ন্ত বাতাসে নৌকা পাল যেমন নৌকাকে এগিয়ে নেয় তেমনি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়ে স্বাধীনতার পূর্বাভাস দিচ্ছিল ঠিক তখনই অন্য প্রান্তে শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্ত গঙ্গা বয়ে গেছে। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর দিন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ।  

‘স্বাধীনতা’ জাতির গৌরবময় এ অর্জনের প্রতিটি পাতায় জড়িয়ে রয়েছে আত্মাহুতি আর নৃশংসতার করুণ ইতিহাস। গণহত্যার বর্বর ইতিহাস। কোটি মানুষের আহাজারি, নারীর ত্যাগ আর মৃত্যু। নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার পণ। আর নিরস্ত্র বাঙালির কাছে মৃত্যুই যেন শক্তি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কতগুলো নৃশংস গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে, তা স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও চিহ্নিত হয়নি। গণহত্যার প্রকৃত তথ্য নিয়ে সরকারি পর্যায়ে হয়নি বস্তুনিষ্ঠ কোনো গবেষণাও।

একটি দেশ স্বাধীন হলেও তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয় মেধাবীরা। স্বাধীন হলেও বাঙ্গালীরা জাতি হিসেবে যেন না দাঁড়াতে পারে এমন ভাবনায় হত্যা করা হয় সূর্য সন্তানদের। গণহত্যার শিকার এ মানুষরা আমাদের দেখিয়েছিলে আলোক রশ্মি। আলোর বিচ্ছুরনে আমাদের পথ চলতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাঁদের অনেককেই ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। 

তাঁরা হলেন- লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য, আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, রাশীদুল হাসান, আনোয়ার পাশা, আবুল কালাম আজাদ, এ এন এম ফয়জুল মাহী, সিরাজুল হক খান, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ, পিপিআইয়ের ব্যুরোপ্রধান সৈয়দ নিজামুল হক, ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, ফজলে রাব্বী, মোহাম্মদ মোর্তজা, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভিনসহ আরও অনেকে। 

স্বাধীনতার উষালগ্নে বাংলাদেশের সেরা অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও আরও অনেককে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সদস্যরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

শুধুমাত্র স্বাধীনতার পূর্ব মূহুর্তেই তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তা নয়। তাদের উপর হত্যাকাণ্ড চালানো হয় ২৫ মার্চ রাত থেকেই। পাকিস্তানিদের এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যই ছিল রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।   এসব ব্যক্তিরাই স্বাধীনতার পথকে বিভিন্নভাবে সুগম করেছিলেন। ২৫ মার্চের রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বা শিক্ষকদের কোয়ার্টারগুলোতে ভয়ংকর আক্রমণ করে যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, এ এন এম মুনিরুজ্জামান, মুহম্মদ আবদুল মুকতাদির, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, আতাউর রহমান খান খাদিমসহ আরও অনেকে।  

সে সময় গোবিন্দচন্দ্র দেব ছাড়াও গুরুতরভাবে আহত জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতার কথা। পাঁচ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপক এ এন এম মুনিরুজ্জামান নিহত হন। মার্চে পাকিস্তানী সেনাদের অগ্নিকাণ্ডে দৈনিক সংবাদ’র অফিসের ভেতরে আগুনে পুড়ে মারা যান শহীদ সাবের। এ মাসেই কবি মেহেরুন্নেসা ঘাতকদের হাতে নিহত হন।

ডিসেম্বরের এ দিনে শত্রুমুক্ত হয় ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুরের পূবাইল, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও বৈদ্যের বাজার, বগুড়া জেলার শেরপুর ও শিবগঞ্জ থানাসহ জেলা শহরের একাংশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুরসহ সিরাজগঞ্জ এলাকা, আক্কেলপুর ও পাঁচবিবিসহ জয়পুরহাট জেলা, যশোরের কেশবপুর, রংপুরের মিঠাপুকুর, চট্টগ্রামের বান্দরবান, চান্দনাইশ, সাতকানিয়া, পটিয়া ও কুমিড়া, ব্রাহ্মবাড়িয়ার নবীনগর, কিশোরগঞ্জের তাড়াইল প্রভৃতি এলাকা। এদিনই সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান পূর্বাঞ্চলীয় দখলদার বাহিনী প্রধান নিয়াজী ও গভর্নর ডা. মালিকের কাছে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিয়ে এক তারবার্তা পাঠালে চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ে দখলদার বাহিনীর মনোবল।

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের প্রাক্কালে এ দিন মুক্তিযুদ্ধের যৌথ কমান্ড মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে রাজধানী ঢাকা। দখলদার বাহিনীর সব কয়টি ডিভিশন ইতিমধ্যেই সেন্ট্রাল কমান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

১৪ ডিসেম্বর দখলদার বাহিনী যখন ঢাকায় নির্দয়ভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যা করছে, ঠিক তখন যৌথ বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে তুরাগ নদীর পশ্চিম পাড়ে পৌঁছে গেছে। পশ্চিম ও পশ্চিম-উত্তর দিক থেকে ঢাকাকে ঘিরে ফেলে মুক্তিবাহিনী তৈরি করে কালিয়াকৈর-সাভার-মিরপুর-ঢাকা বেষ্টনী। দিশেহারা পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও হানাদার বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনার লক্ষ্যে ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হাউসে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসবেন। 

মিত্রবাহিনী এ বৈঠক পণ্ড করার লক্ষ্যে ঢাকায় গভর্নর হাউসে বিমান হামলা চালায়। এ হামলায় গভর্নর হাউস ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপায়ন্তর না দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিপরিষদ পদত্যাগ করে। এসময় চট্টগ্রামে দখলদার বাহিনীর কামানের অবস্থানসহ গ্যারিসন, ওয়্যারলেস স্টেশন, জ্বালানি ডিপো ও বন্দরসমূহের ওপর ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ক্রমবর্ধমান বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

এমএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি