জাবির র্যাগিং কালচার: বিকৃত রুচির আস্ফালন
প্রকাশিত : ২৩:০৩, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৪:০৪, ১ মার্চ ২০১৮
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের (র্যাগিং) বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে গা শিউরে উঠে। কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভাষ্য ছিল মোটামুটি একই রকম। একটি গণমাধ্যমের খবর হুবুহ তুলে ধরছি, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট’-এর ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান সোমবার ক্লাস করতে যান তার বিভাগে। এসময় জামার হাতা গুটানো ছিল তার। আর বন্ধুর চোখে ছিল সানগ্লাস। আল বেরুনি হলের ৪৬তম ব্যাচের কয়েকজন সিনিয়রের কাছে বেয়াদবি ঠেকে এটি।
নিজেদের পরিচয় না দিয়ে আশিকুর এবং তার সাথে থাকা বন্ধুকে ডেকে নিয়ে আল বেরুনি হলের সামনে পরিচয় জানতে চান তারা। পরিচয় দেওয়ার পদ্ধতি পছন্দ না হওয়ায় শুরু করেন ধমকাধমকি। এরপর আশিকুরের কাছে জানতে চান শার্টের হাতা গুটানো কেন (ক্যাম্পাসে নবীন শিক্ষার্থীদের জামার হাতা গুটিয়ে না রাখার সদ্যসিনিয়রদের নির্ধারণ করে দেওয়া এক অলিখিত নিয়ম)।
জবাবে আশিকুর জানান, জামার হাতা গুটিয়ে রাখা যাবে না, তা হলের বড় ভাইরা বলেননি। জবাব শুনে শুরু হয় গালিগালাজ। গালিগালাজ না করতে আশিকুর রহমান অনুরোধ করলে শুরু হয় মারপিট। থাপড়াতে থাপড়াতে আশিকুরকে কাছে থাকা পুকুরে ফেলে রেখে যান তারা। পরে সেখান থেকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাভারের একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পাঠান আশিকুরকে।’
আমার মনে হয়, নবীন শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের (র্যাগিং) ঘটনা ঘটে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই। তবে তার মাত্রা বেশি জাহাঙ্গীরনগরে। প্রতিবছর যখন নতুন বর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসে, তখনই শুরু হয় র্যাগিংয়ের নামে এক শ্রেণির কথিত সিনিয়র শিক্ষার্থীদের বিকৃত রুচির উল্লোম্ফন। ছাত্র বা ছাত্রী, একক, যৌথ বা দল বেধে শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেওয়া হয়।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। নতুন বর্ষের শিক্ষার্থীরা আসার পর দেখতাম, প্রতিরাতেই গণরুমে সবাইকে দাঁড় করিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কায়দায়, একেক দিন র্যাগ দেওয়া হতো। কোনো দিন সবার মুখে সিগারেট গুঁজে দেওয়া হতো। কোনো দিন সেনা সদস্যদের মতো কথিত শারিরীক কসরত দেখাতে হতো শিক্ষার্থীদের। আইয়ুব বাচ্চু বা জেমসের সুরে বিকট চিৎকারে গান গাওয়া, বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মতো মারামারি, কত কিছুই না করানো হয় নবীন শিক্ষার্থীদের দিয়ে। কথা না শুনলেই তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন। একক নয়, দল বেঁধে নতুন শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। কথিত এইসব সিনিয়ররা সবসময়ই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
আলাপচারিতায় দেখেছি, ছাত্রসংগঠনের সেসব নেতা-কর্মীরা অনেকটা গর্ব সহকারে র্যাগ দেওয়ার কথা স্বীকার করতো। আশ্চর্য লাগতো তাদের রুচিবোধে। যারা র্যাগ দিয়ে মজা পায়, তাদের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে বিভিন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা। দিনমজুর থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের সন্তানরা আসে উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠে। সেখানে কতিপয় বিপথগামী শিক্ষার্থীদের কাছে নির্যাতন সইতে হয় নতুন শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেই এ ধরণের অভিজ্ঞতা তাদের মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে দেয়। তারাও প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠে।
সাংবাদিকতার কাজে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যাই দীর্ঘ দিন। বেশ জানাশোনাই আছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে। কথা হচ্ছিলো এক যুগ্ম-সচিবের সঙ্গে। জাহাঙ্গীরনগর প্রসঙ্গ আসতে একদিন বলে ফেললাম, আমি তো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। ভদ্র নারীর মুখটা চুপসে গেলো। কোথাও কোনো সমস্যা- মনে হলো। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি যেটা বললেন, অনেক দিন থেকে তোমার সঙ্গে জানা শোনা। তোমাকে ছেলের মতই দেখি। তাই রাগ করতে পারলাম না। কিন্তু আমি জাহাঙ্গীরনগরের কাউকে দেখলে অস্বাভাবিক হয়ে যাই। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, তার মেয়ে জাহাঙ্গীরনগরের বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের অনিচ্ছা সত্বেও তাকে হলে পাঠান। জাহানারা ইমাম হলের শিক্ষার্থী ছিলেন সেই মেয়ে। প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যেই তাকে র্যাগ দেওয়া হয়। প্রতিদিন একেক স্টাইলে। একদিনের র্যাগিং ছিল এমন, বাথরুমের ভেজানো (সম্ভবত তাতে প্রসাব লাগনো ছিল) কাপড় গায়ে জড়ানো। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন সে মানসিকভাবে সুস্থ হতে পারেনি। ভর্তি বাতিল করে তিনি পরে তাকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। পরে আর তার রুমে যেতে পারিনি, তার অস্বস্তির কারণ হতে চাইনি।
জাহাঙ্গীরনগর, আমার বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান বা সাবেক অনেক শিক্ষার্থীকে ইনিয়ে বিনিয়ে র্যাগিংয়ের পক্ষে কথা বলতে শুনি। এটা না কি আমাদের সংস্কৃতি! হায়, আমরা যারা র্যাগিংয়ের পক্ষে, তার ভাই বা বোনের মুখে যদি সিগারেট গুঁজে দেওয়া হয়, অর্ধনগ্ন করে এক পায়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাড়া করে রাখা হয়, একই বাথরুমে রাতভর আটকে রাখা হয়, আমার অনুভূতি কি হবে তখন?
র্যাগিং নিয়ে প্রশাসনের ব্যর্থতা ছিল বরাবরই। আমাদের সময় দেখেছি, র্যাগিং বন্ধে সচেতনতার জন্য ক্যাম্পাসে পোস্টারিং করা হয়েছিল। তাতে প্রক্টরসহ কয়েকজন সহকারী প্রক্টরের ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, র্যাগিং বন্ধে অভিযোগদানকারীদের নাম গোপন রেখে বিচার করা হবে। হায়, সে তালিকার বেশিরভাগ শিক্ষকই ফোন ধরতেন না। কেউ বা রিসিভ করলে বলতেন দেখছি, পরে আর ব্যবস্থা নিতেন না। তবে, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরকে দেখেছি, ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিতে। তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিতেন। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন বলে কাউকে ছাড় দিতেন না। র্যাগিং মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়া তার একটি উদ্যোগ ছিল। অনেকটা সফলও হয়েছিলেন বলা চলে। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সময় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেছেন, হলের প্রভোস্টসহ অন্য শিক্ষকরা তাকে সহযোগিতা করছেন না। তিনি কিভাবে ব্যবস্থা নিবেন, কারণ, প্রশাসন তো সবার সমন্বয়ে একটি বডি। তার এমন বক্তব্য শোনার পর, নবীন শিক্ষার্থীরা হয়তো র্যাগিংয়ের ভয়াবহতায় আরেকটু ভীতই হবে।
একটা ভাবনা আসে মাথায়। জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সৌজন্যতা, আচরণ শেখানোর দায়িত্ব সিনিয়র শিক্ষার্থীদের কে দিয়েছে? সময়টা পাল্টেছে, পরিবর্তন হয়েছে প্রতিযোগিতার ধরণ। বিসিএস বা করপোরেট চাকরি, সাংবাদিকতা বা উদ্যোক্তা হয়ে গড়ে উঠা... সবকিছুতেই এখন কত চ্যালেঞ্জ। অথচ, আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতশ একরের মাঝে থেকে আমরা যেনো নিজেদেরও সীমাবদ্ধ করে ফেলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা পার হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে উঠলেই দুনিয়াটা বড় হয়ে যায়। প্রতিযোগী মনে হয় সবকিছু। চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়, সবাইকে পেছনে ফেলে নিজের আসনকে পাকাপোক্ত করা। কাঠামাবদ্ধ হলের সীমানায় আটকে থেকে যেন বধির হয়ে যায় আমাদের চিন্তাধারাও। হায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের বোধোদয় হবে কবে?
লেখক# বিজনেস রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
ইমেইল :shuvro.ju@gmail.com
এসএইচ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।