জীবনকে বোঝার ও নিজেকে খোঁজার সুযোগ দিয়েছে লকডাউন
প্রকাশিত : ১৯:৪৯, ২৮ মে ২০২০

করোনা। কোভিড-১৯। শব্দগুলো আমার কাছে খুব নতুন। কিন্তু খুব চেনা হয়ে গেছে মাত্র তিন মাসে। প্রতিদিন যেমন আমি প্রিয়জনদের কথা মনে করি, সেরকম প্রতিদিনই করোনাকে নিয়ে ভাবতে হয়। ঠিক করে রেখেছিলাম এসময় কী করব, কেমন করে সময় কাটাব। কিন্তু এ তো অসম্ভব—প্রশ্নই ওঠে না ঘরে বসে থাকার বা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়ার। তার মধ্যে আমার ছেলে দুটো থাকে আমেরিকায়। দিন দিন আমার মনটা অস্থির হয়ে উঠল। ছবি আঁকাতেও মন বসাতে পারছিলাম না।
এরকম পরিস্থিতিতে তো কোনোদিন পড়ি নি বড় হয়ে। ছোটবেলায় যুদ্ধবন্দি অবস্থায় থেকেছি ১৯৭১ সালে। তারপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরও অনেক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে গেছি মায়ের সাথে, বোনদের নিয়ে। কিন্ত এ তো মহামারী! পালিয়ে যাব কোথায়? সবখানে একই অবস্থা। আমরা শিশুদের কাছেও যেতে পারছি না। প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছি। চারদিকে শুধু করোনা-বিষয়ক খবর। কী এক অবস্থা!
এরই মধ্যে আমার এক বান্ধবী বলল যে, গুরুজীর কণ্ঠে দোয়ার একটা নতুন মেডিটেশন এসেছে কোয়ান্টাম থেকে। সে আমাকে মেডিটেশনটা পাঠিয়ে দিল। তারপর আমি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বনানী শাখার অর্গানিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তিনি আমাকে গাইড করেন। সকাল ৯.৩০ মিনিটে পারিবারিক মেডিটেশন এবং রাত ৯টায় দোয়া মেডিটেশন—চমৎকার অনুভুতি হলো আমার। প্রতিদিন এভাবেই মেডিটেশন করতে থাকলাম এবং দেখলাম মনটা অনেক স্থির হয়ে গেল।
গুরুজীর আলোচনাগুলো এবং শবে বরাতের অনুষ্ঠানসূচিও পেলাম শাখা থেকে। সবই পালন করলাম। গত বছর ঠিক এই সময় আমি কোয়ন্টাম মেথড কোর্স করেছিলাম। কোর্স করার পরে আমি কোনো প্রোগ্রামই বাদ দেই নি। গতবছর কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআন, শবে কদরের প্রোগ্রাম, আখেরি দোয়া, কোয়ান্টাম মেথড কোর্স রিপিট এবং সবগুলো প্রজ্ঞা জালালিতে অংশ নিই।
এদিকে আমার বাসায় বর্তমানে শুধু একজন আছে দৈনন্দিন কাজে সাহায্যের জন্যে, সে হচ্ছে সালমা। সে আমার কাছে আছে ১৫ বছর। সে আমাদের পরিবারেরই একজন। আমি আর সালমা ঘরের সব কাজ ভাগ করে নিয়েছি। ভালোই লাগছে এবং আল্লাহর রহমতে সুন্দরভাবে দিন কাটছে। পারিবারিক মেডিটেশন করতে গিয়ে যখন বাবা-মাকে নিয়ে ভাবছি, হঠাৎ মনে হলো আমার স্বামীর ২৮ বছর বয়সে তার মা ইন্তেকাল করেন এবং এর দুবছর পর বাবাও ইন্তেকাল করেন। বলা যায়, কম বয়সেই তিনি মা-বাবাকে হারিয়েছেন। খুব কষ্ট লাগল আমার স্বামীর জন্যে। মনে হলো, তাকেও পারিবারিক মেডিটেশনটা করাই। জিজ্ঞেস করতেই রাজি হয়ে গেলেন। মেডিটেশনের সবকিছু বুঝিয়ে দিলাম কারণ কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে অংশ নেয়া হয় নি তার।
মেডিটেশন শেষ হলে জানতে চাইলাম, কেমন লাগল? তার জবাব—খুব ভালো। কয়েকদিন পর আমি ‘আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী’ শুনতে শুরু করলাম। আমার স্বামীও আমার সাথে সাথে বসে শুনতে লাগলেন। এখন তো আমার চেয়ে তিনিই বেশি উৎসাহী। কোনো কারণে আমি যোগ দিতে না পারলে তিনি নিজেই আসরের নামাজের পর গুরুজীর অডিও ছেড়ে দেন। করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে গুরুজীর আলোচনা শুনে তিনি মুগ্ধ। এরপর নিজেই ইউটিউবে খুঁজে খুঁজে গুরুজীর বিভিন্ন আলোচনা শুনতে শুরু করলেন। আমি আবার একটু ঠাট্টা করে বললাম—‘‘কী? ‘আমার’ গুরুজীকে নিয়ে এত আগ্রহ!’’ সিরাত পাঠের আসরগুলো আমরা একসাথে বসে ইফতারের আগে শুনেছি তিন দিন। এরপর তিনি গুরুজীর সব আলোচনা এবং কোয়ান্টামের ভিডিওগুলো শেয়ার করতে শুরু করলেন তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এমনকি পরিচিত যারা ধর্মের প্রতি উদাসীন তাদেরকেও।
তারপর কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআনের সময়সূচি পেলাম। গতবছর যখন এ প্রোগ্রামের প্রথমদিন আমি বনানী শাখায় গেলাম, সাথে আমার সহযোগী সালমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম না প্রোগ্রামটি শুধু কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েটদের জন্যে। এবার বাসায় বসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে খতমে কোরআন করা যাবে শুনে সালমাকে যখন বললাম, সে-তো খুব খুশি। আমার স্বামীকে বললাম টিভিটা যেন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আমাদের ছেড়ে দেয়া হয়। জানতে চাইলেন কারণ কী? শুনে তিনিও আমাদের সাথে যুক্ত হলেন।
পহেলা মে শুক্রবার সকালে খতমে কোরআনের জন্যে তৈরি হয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার স্বামী বললেন—একটু অপেক্ষা করো, আমি ওযু করে আসছি। আমি তো অবাক! প্রথম দুইদিন তার মধ্যে একটু অস্থিরতা কাজ করেছে কিন্তু পরের পাঁচ দিন একেবারে প্রশান্ত। পরের শুক্রবার আমরা শরিক হলাম আখেরি দোয়াতে। গুরুজীর আবেগঘন, হৃদয়গ্রাহী এ দোয়াতে আমি গত বছরও অংশ নিয়েছিলাম। সত্যি আমি অভিভূত হয়েছিলাম। এবার যেন আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করতে পেরেছি আরো বেশি। দোয়ার সময় আমি খুব একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম, হঠাৎ ধ্যান ভেঙে গেল আমার স্বামীর কান্নার আওয়াজ শুনে। সেই দিনের সেই সময়ের পরিবেশ আমি বর্ণনা করতে পারব না। আমি তাকে এত আবেগপ্রবণ হতে কোনোদিন দেখি নি।
এরপর ইসলামকে জানার এবং বোঝার ব্যাপারে খুব আগ্রহ জন্মেছে তার ভেতর। চেষ্টাও করছেন কিন্তু কোনো প্রশ্ন জাগলেই বলেন, ‘আচ্ছা, তোমার গুরুজীকে জিজ্ঞেস কোরো।’ ১৫ মে সকালে গুরুজীর সাদাকায়নের আলোচনা ঘরে বসেই শুনেছি। পুরোটা শোনার পর আমার স্বামী বলে উঠলেন, ‘আসলে গুরুজী ঠিক বলেছেন। সঙ্ঘবদ্ধ দানই ভালো। আমি একজন এতিমের দায়িত্ব নেব।’
এবার নিজের কথা বলি—খতমে কোরআনের পর নিজেকে অনেক ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। কিছু বিষয়ে ভুল ধারণা ছিল আমার, সেগুলো দূর হয়েছে। আমি এখন অনেক প্রশান্ত। হুট করে রেগে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে কোয়ান্টামের মতো একটি মানবিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ গুরুজীর কাছে যিনি তার সমস্ত মেধা, ধৈর্য, শক্তি, সাহস এবং তার সবকিছু মানুষের কল্যাণে উজাড় করে দিয়ে আমাদেরকে সৎপথে, আল্লাহর পথে, সুন্দর জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যচ্ছেন।
আমি মনে করি, কোয়ান্টামে একাত্ম হওয়ার পর মানুষ হিসেবে আমি আরো উন্নতি লাভ করেছি, আলোকিত হয়েছি। আমার জ্ঞনের পরিধি বেড়েছে। এই লকডাউনে গুরুজীর প্রোগ্রামগুলো এবং আলোচনা, মেডিটেশন (পারাবারিক এবং দোয়া) না থাকলে দিনগুলো ভালোভাবে কাটানো খুব কষ্টকর হতো। এবার গুরুজীর দিক-নির্দেশনা অনুসরণ করে ঘরে বসেই আমাদের মতো কত মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে উপকৃত হয়েছেন! করোনা যেমন আমাদের জীবনে এনেছে ভয়ভীতি হতাশা অনিশ্চয়তা, তেমনি লকডাউন আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে জীবনকে বোঝার, নিজেকে খোঁজার। আবারো গুরুজী, মা-জী ও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সবাইকে হৃদয়ের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানাই এবং সবকিছুর জন্যে শুকরিয়া জানাই আল্লাহর কাছে।
লেখক: চিত্রশিল্পী ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের কবল থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচাতে জীবন উৎসর্গীকৃত শহিদ কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম)-এর কন্যা।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।