ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

জীবনযুদ্ধে হার না মানা প্রতিবন্ধী সাবরিনার গল্প

প্রকাশিত : ১৪:১৭, ১১ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৪:২৩, ১১ মে ২০১৯

অল্পতেই যারা হাল ছেড়ে দেয়, বিরক্ত হয় আশেপাশের জগতটার উপর, তাদের জন্য এই গল্প। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি নেই, এমন অজুহাতে যারা আফসোস করে, গল্পটা তাদের জন্য। "মেয়ে হয়ে জন্মেছি, কী আর করব"- এমন কথা যারা বলে, গল্পটি তাদের জন্য।

দেশে মানুষের অধিকার নিয়ে যেসব সরকারী-বেসরকারী সংগঠন কাজ করে, কম বেশি সবাই চেনে তাকে। ইতিমধ্যে অনেকবার জাতীয় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় কাভারেজ পেয়েছেন। পেয়েছেন দেশ বিদেশের ছোট বড় স্বীকৃতি। তিনি লড়াই করেন, স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান। তিনি সাবরিনা। অপরাজেয় সাবরিনা।

সাবরিনা সুলতানা বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান) - এর সভাপতি। বি-স্ক্যান প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন। বিশ্বে ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৯০ কোটি। বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা দেড় কোটি। এই দেড় কোটি মানুষের প্রাত্যাহিক সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিনিয়ত যিনি জোরালো আওয়াজ তোলেন তিনিই সাবরিনা।

আন্দোলন অনেকেই করেন। কিন্তু সাবরিনার সঙ্গে অন্যদের একটা জায়গায় পার্থক্য আছে। সাবরিনা নিজেই একজন প্রতিবন্ধী নারী। দুরারোগ্য ব্যাধি মাসকুলার ডিসট্রোফিতে আক্রান্ত তিনি। তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন। দুই হাতের দুটি আঙ্গুল ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে সক্ষম নন তিনি। হুইল চেয়ারের সামনে ছোট্ট একটা পাটাতনে রাখা আছে ল্যাপটপ। কানে হেডফোনের সঙ্গে সংযোগ দেয়া স্মার্টফোনের। এই তার পৃথিবী।

এখানে বসেই প্রায় দুদশকের কাছাকাছি সময় সাবরিনা কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধী মানুষদের কল্যাণে। প্রতিটি ভবনে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রবেশ উপযোগী সিঁড়ি পথ নির্মাণ করা, সরকারী-বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী মানুষদের ব্যবহারোপযোগী টয়লেট নির্মাণ করা, প্রতিটি পরিবহনে ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষদের বসার উপযোগী আসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা- এ রকম অনেক দাবি নিয়েই কাজ করে বি-স্ক্যান। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবরিনা।

সাবরিনার জীবন শুরু হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। অন্যদশজন শিশুর মতোই তিনিও বাড়ির এখানে সেখানে ছোটাছুটি করতেন। দৌঁড়ে পার হতেন একের পর এক সিঁড়ি। ছোট্ট বাবরি চুল দুলিয়ে স্কুলে যেতেন। কিন্তু তার সেই প্রাণবন্ত শৈশব বেশি দিন থাকেনি। বন্ধ হয়ে যায় স্কুলে যাওয়া। সাবরিনার ভাষায়, "ক্লাস ফোরের পর আমার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি।"

বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের একটি বাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে থাকেন সাবরিনা। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি ফিরে যান তার সেই ছোট্ট বেলায়।

বলেন, "একদিন আম্মু আমাকে বাথরুমে গোসল করাচ্ছিলেন। গোসল শেষ হলে তিনি আমাকে উঠে দাঁড়াতে বলেন। কিন্তু আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। আম্মুকে বললাম, আমি দাঁড়াতে পারছি না। আম্মু প্রথমে ভাবলেন, আমি দুষ্টুমি করছি। পরে দেখা গেল আমি দাঁড়াতে গেলেই পড়ে যাচ্ছি।"

এরপর ধীরে ধীরে শুরু। স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় আশেপাশে বা বাইরে যাওয়া। সময়ের ব্যবধানে শরীরের সকল অঙ্গগুলো তাদের কার্যকারিতা হারাতে থাকে। একপর্যায়ে তার ছোট বোনেরও একই রোগ ধরা পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগকে বলা হয় মাসকুলার ডিসট্রোফি।

চিকিৎসা বিজ্ঞান জানাচ্ছে মাসকুলার ডিসট্রোফি রোগটি সংক্রামক নয় তবে জিনগত। পূর্বপুরুষদের কারো না কারো এই রোগ থেকে থাকলে দীর্ঘদিন পরে গিয়েও বংশধরদের মাঝে এই রোগ দেখা দিতে পারে।

এই রোগে পেশি ভয়ানক দুর্বল হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পেশি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। মানুষ তার চলন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। জিনগতিতে থাকে ভুল সংকেত। আর তাই সুস্থ পেশি তৈরির জন্য প্রোটিনগুলো তৈরি হয় না। পেশিগুলো কালক্রমে দুর্বল হতে থাকে, হাঁটাচলা-ওঠাবসা কষ্টকর হয়ে উঠে। একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়।

সাবরিনার পরিবার তাদের জন্য দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নেয়। যখন যেখানে যে ডাক্তারের পরামর্শ কারো কাছে পেয়েছে সেখানেই ছুটে গেছে। কিন্তু ফলাফল শুন্য।

সাবরিনা বড় হতে হতে বুঝতে শিখে তার পৃথিবীটা থমকে আছে চার দেয়ালের মাঝে। কিন্তু মন থেকে এ পরাজয় মেনে নেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। শুধু নিজে নয় বোনটাও অসুস্থ। বাবা মায়ের মনের কষ্টের বোঝা টের পান সাবরিনা। মন হয়ে উঠে বিদ্রোহী।

নিজে নিজে পড়াশুনা শুরু করেন। হুইল চেয়ারে বসেই পড়তে থাকেন নানা রকম বই। নিজের চেষ্টায় বেশ ভালভাবেই আয়ত্ত্ব করেন ইংরেজি ভাষা। শুরু করেন ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি। নিজের অজান্তেই বিদ্রোহী মন নিয়ে একদিন লেখালেখি শুরু করেন সাবরিনা।

নিজেদের কষ্টকর অভিজ্ঞতা নিয়ে সাবরিনার লেখা প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর জনপ্রিয় ফিচার পাতা আজমিশালিতে। লেখার শিরোনাম ‘স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না’। তারপর থেকে শুরু। এরপর আর থেমে থাকা নয়। ব্লগার হিসেবে সাবরিনা হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য। আমার ব্লগ, প্রথম আলো ব্লগ, চতুর্মাত্রিক, শব্দনীড় সবজায়গায় সাবরিনার সমান বিচরণ।

সাবরিনা উপলব্ধি করেন, প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনে বড় সমস্যাটির নাম `বাধা`। চলাচলে বাধা, শিক্ষাগ্রহণে বাধা, নাটক দেখার বাধা, অন্যদের মতো সম্মেলনস্থলে পৌঁছাতে বাধা। সাবরিনা বুঝেন একা একা লড়াই করা যায় না। প্রয়োজন সংঘবদ্ধতা। সেই চিন্তা থেকে ২০০৯ সালে সাবরিনা তার আরও বন্ধুদের নিয়ে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলেন। ‘বি-স্ক্যান’ অনলাইন গ্রুপ। যা পরবর্তীতে রূপ পায় সংগঠনে।

বর্তমানে বি-স্ক্যান একটি পরিপূর্ণ সংস্থা। যেখানে শারীরিকভাবে অক্ষম তরুণ তরুণীরা ছাড়াও অনেকে স্বেচ্ছায় কাজ করছেন। মূলত প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের দাবি রাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরা, প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে সামাজিক কুসংস্কার দূর করা, জনসচেতনতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বি-স্ক্যান কাজ করে।

ইতিমধ্যে জার্মানভিত্তিক সংবাদ সংস্থার ব্লগ ভিত্তিক একটি প্রতিযোগিতায় সারা বিশ্বের অনেক প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন সাবরিনা।

সাবরিনা লেখার বিষয় অধিকার। প্রতিবন্ধী মানুষরা তাদের জীবনে চলার অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই সে লেখে তাদের স্বাভাবিক জীবনের অধিকার নিয়ে। সর্বত্র প্রবেশগম্যতা চাই। চলাচলের সুবিধা চাই। ভবনে, বাসে, রেলে, টয়লেট সবজায়গায় প্রবেশগম্যতার সুবিধা চাই।

সাবরিনা দিনরাত পরিশ্রম করেন এই হুইল চেয়ারে বসেই। তার কোনো ক্লান্তি নেই, তার কোনো অবসর নেই। দুই আঙ্গুলে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেন। ক্লান্ত হয়ে যান। আবার শুরু করেন। তার থেমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাকে পথ চলতেই হবে।

আআ//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি