জীবনের চাকা থেমে যায় যখন তখন!
প্রকাশিত : ১৯:৫৮, ৮ জানুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ২০:০৫, ৮ জানুয়ারি ২০২৩
রাত নয়টায় অফিস থেকে বেরিয়ে হাঁটছি। বসুন্ধরা গেটে ছোট একটা কাজ আছে। তাই হাঁটছি। প্রচন্ড শীত। মোটা জিন্সের নিচে ট্রাউজার, মোটা মোজা, হাইনেক বুট, সোয়েটার, গেঞ্জি, হুডি, ক্যাপ, মাস্ক তবুও যেন ঠান্ডা ঢুকছে শরীরের হাড্ডিতে।
গ্রামীণ ফোন হেড অফিসের কাছাকাছি আসতেই চোখ আটকে গেল। ইউসিবিএল বুথের সামনে একটা থামা রিক্সা। ফুটপাথে বসে চালক মাথা ঠ্যাস দিয়ে রেখেছে সিটের নিচে। তাকিয়ে দেখলাম অনবরত রক্ত বমি করছে। কাঁচা রক্ত। হঠাৎ অবচেতন হয়ে মাটিয়ে নেতিয়ে পড়ল। দ্রুত এগিয়ে তাকে ধরলাম। বেশ তরুণ রিক্সাচালক ২৮/৩০ বছর বয়স। নাম বলতে পারল। ছিরুল আলী। বাড়ি রাজশাহীর নাচোল।
রাস্তার পাশে বসিয়ে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করলাম৷ কেউ দাঁড়াল না৷ এভাবেই ১০ মিনিটের মত কেটে গেল। এবার অন্য এক রিক্সাওয়ালাকে থামালাম। অনুরোধ করে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে সহযোগিতা প্রয়োজন। যেহেতু বিপদগ্রস্ত লোকটিও রিক্সাচালক তাই সে রাজী হয়ে গেল। দুজনে ধরাধরি করে ওকে রিক্সায় তুললাম। এবার বিপদ হলো ছিরুলের রিক্সটা কি করবো। রাস্তায় তো ফেলে যাওয়া যায় না। জ্যামও আছে৷ এবার ছিরুলের রিক্সা নিয়ে আমি ছুটলাম পেছন পেছন।
রিক্সা চালানো যে মোটেও সহজ নয় তা আজ টের পেলাম। একটু এদিক সেদিক হলেই বিপদ। অন্য রিক্সাচালকরা আমাকে রিক্সা চালক ভেবে কেউ কেউ গাল মন্দও করলো। এরই মধ্যে আচমকা এক গাড়ীর লুকিং গ্লাসে লেগেই গেল সামান্য। যদিও ভুলটা গাড়ীর চালকেরই ছিল। যাই হোক পৌঁছালাম বসুন্ধরা গেটে লাইফ লাইন হেলথ সেন্টারে। যেটা কিনা বড় লোকদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
লিফট দিয়ে ওপরে উঠেই একজন কম বয়সী মেয়ে এটেন্ডডেন্টকে পেয়ে হেল্প চাইলাম। মেয়েটা বেশ চনমনে ছিল। হুইল চেয়ার এনে দিল। ছিরুলকে বসালাম।
ডাক্তারের রুমের সামনে অপেক্ষা করছি৷ ছিরুল তখনও নিস্তেজ৷ আবার বমি করল। এরই মধ্যে ডাক্তারের কক্ষে ঢুকে নিজের পরিচয় দিলাম। ছিরুলের অবস্থা জানালাম। ডাক্তার আবুল বাশার বিশ্বাস। সাদা কালো দাড়ি, মাথায় টুপি, সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত। ছিরুলকে বেশ যত্ন নিয়েই দেখলেন। প্রেসার ৯৫/৬০। ব্লাড সুগার সাড়ে ৩। এমনিতেই ঠান্ডা। ধূমপায়ী ছিরুল আলসারের রোগী৷
স্যালাইন খাওয়ালাম, অন্য আরেকটা ওষুধ খাওয়ালাম ছিরুলকে।
মিনিট দশেক পর ছিরুলের হুশ ফিরল। কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরল। ওর সাথে থাকা আইডি কার্ডে রিক্সার মালিকের ফোন নম্বর পেলাম। সেখানে ফোন করে ঘটনা বলে আসতে বললাম। মিনিট ১৫ পর লোক আসল গ্যারেজ থেকে। পুনরায় ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। উনি ফি নিলেন না। উল্টো বললেন আপনার সাথে একটা ভাল কাজে শরীক হলাম। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ৫ দিনের ওষুধ কিনে দিলাম। ছিরুলকে বুঝিয়ে দিলাম৷ নিচে রিক্সাটা এক সবজি দোকানের সামনে রেখে যাই সেখানেই নামলাম আবার৷ ততক্ষনে আসিফ ইকবাল ভাইও চলে এসেছেন ঘটনাস্থলে।
সবশেষে দুই ভাই মিলে খিলগাঁও এ ফিরলাম। পরে জেনেছিলাম ছিরুলের বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী। পরিবারে সেই একমাত্র উপার্জনক্ষম। অভাবী সংসার। তাই ঠিকঠাক খেতেও পারে না। এ রকম কত ছিরুল আলী শেষ হয়ে যাচ্ছে নিভৃতে অবেলায়। সে খবর রাখা রাষ্ট্রের দ্বায়। অথচ এ রাষ্ট্র সেটা কতখানি করছে তা আমাদের সবারই কম বেশি জানা।
(সাংবাদিক মানিক মুনতাসির এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া)
এসি