জীবনের লক্ষ্য হওয়া চাই অনেক বড়
প্রকাশিত : ১৮:৩৮, ২ জুলাই ২০২৩ | আপডেট: ১৯:০০, ২ জুলাই ২০২৩
জীবনে সাফল্য পেতে প্রয়োজন বড় লক্ষ্য। কেবল সফল জীবনই নয়, সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুরও নিয়ামক হতে পারে ভয়হীন মহৎ লক্ষ্য। Aim in Life রচনা ঝাড়া মুখস্ত থাকলেও জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই অনেক শিক্ষার্থীরই। যাও-বা আছে তা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস ক্যাডারের মতো অল্প কয়েকটি পেশার মধ্যেই সীমিত। আবার অনেকে কোনোরকম একটি লক্ষ্য স্থির করলেও তাতে তাদের আস্থা বা একাত্মতা নেই বা লক্ষানুরণন জোরদার নয়- হালের বাস্তবতা এটাও।
প্রতি ৪ তরুণের মধ্যে ৩ জনই লক্ষ্য নিয়ে বেসামাল। লক্ষ্য নিয়ে দ্বিধান্বিতদের হারে এই ঊর্ধ্বগতি এবং করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় দেড় বছর স্বাভাবিক শিক্ষণপ্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত থাকা, পাবলিক পরীক্ষা না হওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ থাকা- মোটকথা শিক্ষাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তা এই হারকে কতটা বাড়িয়েছে, ভাবনার বিষয় সেটাই।
কারণ লক্ষ্যের ব্যাপারে দৃঢ় থাকতে না পারলে সফল হওয়া যায় না। আসলে সৃষ্টির সেরা জীব হওয়ার সত্ত্বেও জীবনে বড় কিছু করার চিন্তা না করা মানে নিজের সক্ষমতাকে হেয় করা। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম বলেন, জীবনের লক্ষ্যকে ছোট রাখা একটি পাপ!
একটি প্রবাদ আছে- আকাশে তির ছুড়লে কমসে কম গাছের মগডালে বিঁধবে! কিন্তু লক্ষ্য যদি হয় একটা ডালে লাগলেই হলো ধাঁচের, তাহলে আপনার অর্জন হবে বড় জোর ওটুকুই। তাই বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করুন, লক্ষ্যে অনড় থাকুন এবং লক্ষ্যার্জনে ক্রমাগত প্রয়াস চালান। আপনি হবেন সফল, স্মরণীয়-বরণীয়।
দীর্ঘজীবন চান? লক্ষ্যকে বড় করুন! বড় কিছু করার জন্যেই পৃথিবীতে আপনার আবির্ভাব- জীবনের এই উদ্দেশ্য অনুধাবন আপনাকে দীর্ঘদিন বাঁচতেও সহায়তা করবে। ২০১৪ সালে সাইকোলজিকেল সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধে কানাডার একদল গবেষক এমনটিই দাবি করেন ৷
কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষকদল ৬ হাজার অংশগ্রহণকারীর জীবনের লক্ষ্য বিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করেন। ১৪ বছর ফলো-আপ শেষে দেখা গেল, এই সময়ে যে ৫শ ৬৯ জন মারা গেছে, বেঁচে থাকাদের চেয়ে জীবন নিয়ে তাদের প্রত্যাশা বা লক্ষ্য ছোট ছিল।
গবেষকদলের প্রধান প্যাট্রিক হিল বলেন, গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া, এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ্যানুরণন আসলেই আপনাকে দীর্ঘজীবন পেতে সহায়তা করবে। জীবনের যে পর্যায়েই আপনি তা খুঁজে পান না কেন। তবে যত আগে কেউ লক্ষ্য খুঁজে পাবে ততো বেশি ঘটবে এই সুরক্ষামূলক প্রভাব। অন্যদিকে, হার্ভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চাকুরিতে অবসরগ্রহণ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪০ শতাংশ বাড়ায়, এবং অবসরের প্রথম বছরেই তা বেশি ঘটতে দেখা যায়। এ-সময় মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায় ২০শতাংশ!
কারণ, অবসরের সাথে সাথে থেমে যায় নিত্যদিনের পেশাগত কাজ, পেশায় অগ্রগতির লক্ষ্য স্থির ও তা অর্জনের প্রয়াস। তাছাড়া, অধিকাংশ চাকুরিজীবীরই অবসরগ্রহণের পর জীবনের কোনো লক্ষ্য থাকে না। ইউনিভার্সিটি অফ সান ডিয়েগো স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষকদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনে লক্ষ্যের উপস্থিতি এবং উদ্দেশ্য অনুসন্ধান সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ।
মনোরোগ ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক দিলীপ ভি. জেস্টে বলেন, অনেকেই জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য- এই বিষয়গুলোকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে থাকেন। কিন্তু অর্থপূর্ণ জীবনের সাথে সুস্বাস্থ্য, সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুরও যোগসূত্র রয়েছে। যাদের জীবনের লক্ষ্য আছে তারা, যাদের নেই তাদের চেয়ে অধিকতর সুস্থ ও সুখী। অন্যদিকে, নিউ সায়েন্টিস্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধ, স্মৃতিভ্রষ্টতা এড়ানো এবং ভালো ঘুমের নিয়ামক হতে পারে জীবনের লক্ষ্য। বড় লক্ষ্য নিজের ওপর সৃষ্টি করে আস্থা ও বিশ্বাস- একটি দৃষ্টান্ত ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষ।
পাঞ্জাব শিক্ষা বিভাগের একজন নিম্নপদস্থ দরিদ্র কর্মচারী তার ৮ম শ্রেণী পাস ছেলেকে পিয়নের চাকুরি দেয়ার অনুরোধ জানালেন একজন অফিসারকে। ছেলেটিকে দেখে মেধাবী মনে হলো; অফিসার তাকে চাকুরি দেয়ার বদলে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ আর উৎসাহ দিলেন। সেই ছেলে রেকর্ড নম্বর নিয়ে পাঞ্জাব শিক্ষাবোর্ডে মেট্রিকে ১ম হলো। রেকর্ড নম্বর নিয়ে ১ম হল স্নাতকেও। পরবর্তীতে ফুল স্কলারশীপে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পেল। দু জন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ প্রফেসর পল ডিরাক ও রিচার্ড ফাইনম্যান পদার্থবিজ্ঞানের খুব জটিল একটি সমস্যা সমাধানে বছরের পর বছর হিমশিম খাচ্ছিলেন। ছেলেটির পিএইচডি সুপারভাইজার তাকে ১ বছর সময় দিলেন সমস্যাটি সমাধানে; ছেলেটি ৬ মাসে সমাধান করে ফেলল!
পরবর্তীতে তিনি দেশের হয়ে প্রথম নোবেল পেলেন ১৯৭৯ সালে, পদার্থবিজ্ঞানে। তার রিকমেন্ডেশনে তার দেশের পাঁচশ বিজ্ঞানী পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তিনি প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুস সালাম। লক্ষ্যকে বড় করেছেন বলেই তিনি পিয়ন হওয়ার বদলে পরিণত হয়েছেন কালজয়ী পদার্থবিজ্ঞানীতে। সন্তানকে বড় লক্ষ্য দিলে সে অল্প বয়সেই অনেক কিছু করতে পারে এর উদাহরণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান কিশোর অভিমন্যু মিশ্র। সন্তান যেন ডিজিটাল ডিভাইজে আসক্ত না হয় সে-জন্যে ছেলেটির বাবা হেমন্ত মিশ্র তার হাতে দাবার গুটি তুলে দেন যখন তার বয়স মাত্র আড়াই বছর। ছেলেকে দাবা শেখানোর সাথে সাথে লক্ষ্য দেন, তাকে এই খেলায় চ্যাম্পিয়ন হতে হবে! অভিমন্যুর বয়স এখন ১২, এবং এই বয়সেই সে দাবার গ্রান্ডমাস্টার! বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ গ্রান্ডমাস্টার সে।
করোনাকালে কোটি কোটি শিশু-কিশোর-তরুণ যেখানে ভার্চুয়াল ভাইরাস ও ডিজিটাল ডিভাইজে আসক্ত হয়ে পড়েছে সেখানে অভিমন্যু দৈনিক গড়ে ১২ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছে নিজেকে দাবায় আরো বেশি চৌকস করার অনুশীলনে। কারণ তার পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে ১৫ বছর বয়সে সুপার গ্রান্ডমাস্টার এবং তারপর চ্যাম্পিয়ন হওয়া। আসলে এই বয়সী একটি কিশোরকে জোর করে বাজে অভ্যাস থেকে বিরত রাখা কঠিন। কিন্তু যদি তাকে মহৎ একটি লক্ষ্য দেয়া যায় তাহলে সে নিজেই উদ্বুদ্ধ হবে বাজে অভ্যাস ও অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করা থেকে- অভিমন্যুর বাবার সেদিনের এই উপলব্ধি যে কতটা বাস্তবসম্মত ছিল তার দৃষ্টান্ত আজকের দাবা গ্রান্ডমাস্টার অভিমন্যু মিশ্র!
এমএম//