ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

জীবিকাতে শুধু নয়, আঘাতটি জীবনেও

ওমর ফারুক হিমেল

প্রকাশিত : ২০:৪৮, ৩০ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ২১:১৫, ৩০ আগস্ট ২০২০

করোনায় কেমন আছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। এর উত্তর খুঁজতে, জানতে জানাতে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে এই পর্যন্ত কথা বলেছি ৫২টি দেশের প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সাথে, একই সাথে কথা বলেছি ৩০টি দেশে বাংলাদেশি সংবাদযোদ্ধাদের সাথে। সোজাকথা অনুসন্ধান বলছে, করোনা ভাইরাস শুধু প্রবাসীদের জীবিকাতেই নয়, আঘাত করেছে জীবনেও৷ 

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি৷ বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পযর্ন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন বিশ্বের ১৬৯ টি দেশে৷ তারা সবমিলিয়ে সর্বসাকুল্য দুই লাখ ১৭ হাজার মিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন৷ 

অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, অনিবন্ধিত প্রবাসীসহ এখন ১ কোটি ৩০ লাখ। বলাবাহুল্য, করোনার কারণে পুরো অভিবাসন খাতটা দারুণ সংকটে পড়েছে৷ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে৷ এককভাবে শুধু সৌদি আরবেই আছেন ২০ লাখ বাংলাদেশি৷ আরব আমিরাতে আছেন অন্তত ১২ লাখ৷ এছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইনের গড়ে তিন থেকে চার লাখ বাংলাদেশি আছেন৷ একে তো করোনা তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম একেবারেই কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে নানা সংকট তৈরি হয়েছে৷ ওদিকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশিরাও একইভাবে নানা সংকটে৷ এছাড়া করোনা পরিস্থিতির কারণে ছুটিতে আসা দুই লাখ বাংলাদেশি একই দুশ্চিন্তায় আছেন৷ কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আবার কবে তারা কাজে যোগ দিতে পারবেন বা আদৗ পারবেন কী না জানেন না৷।দেশে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা যেখানে ফের বিদেশে যাওয়ার চিন্তায় মগ্ন, তখন বিদেশে থাকা এক কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন বহুমাত্রিক জীবিকা ও জীবনের সংকটে৷

কোভিড-১৯ নিঃসন্দেহে বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। করোনা কোনও ধরণের অস্ত্র নয়, নয় কোনও ধরণের পারমাণবিক যুদ্ধ; সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের এক ক্ষুদ্র আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবীর মানুষ আজ অসহায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত গোটা বিশ্বের ২১৩টি দেশ আক্রান্ত, এই নিষ্ঠুর থাবা বসিয়েছে এ করোনা ভাইরাস। একদিকে প্রতিনিয়ত যেখানে নতুন করে গোটা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। এছাড়াও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি গোটা পৃথিবীকে এক বিশাল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে যা আগামী দিনগুলোতে আমাদের সকলের জন্য হতে চলেছে এক বিশাল অর্থনৈতিক বিপর্যয়।  

প্রথম ধাক্কার করোনা ভাইরাস থেকে দখল কাটিয়ে বিশ্ব একটু স্বস্থির দিকে যখন যাচ্ছিল, আবার দ্বিতীয় ধাক্কায় পৃথিবীর প্রায় দেশ বেশ উদ্বিগ্ন। করোনা ভাইরাসে সফল হওয়া দেশগুলো এখন করোনা ভাইরাসের আক্রমণের মূল কেন্দ্র কোন রাস্তা থেকে তা খুঁজে পাচ্ছে না। মৃত্যু প্যারেডে পরিণত হওয়া দেশ গুলোতে আবার ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে ইউরোপে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও গত জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আবারও করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হতে থাকে। অনেকে একে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, গ্রিস, মন্টিনিগ্রো, অস্ট্রিয়া এ সকল দেশ প্রথম ধাপে করোনা মোকাবেলায় যেখানে ছিলো অনেকটা সফল দ্বিতীয় ধাপে এ সকল দেশকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে।

তা ছাড়া দীর্ঘদিন লকডাউন কিংবা জরুরি অবস্থার কারণে বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট, কফিশপ এবং পানশালাগুলো বন্ধ থাকায় তাদের অনেকে বলতে গেলে একটা দীর্ঘ সময় কর্মহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছেন। যে কোরিয়া ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছিল, সে প্রযুক্তির দেশটিও হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিঞ্জে আবে অসুস্থতার কথা বলে গতকাল পদত্যাগের ঘোষণা দেন, অনেকেই বলছেন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তিনি সরে পড়ছেন। বিশ্বের পরাশক্তিধর কয়েকটি দেশের অর্থ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকায়, এশিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা আছেন বহুমাত্রিক কষ্টে। বেশি সংকটে আছেন মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা অভাব অনটন ঘোচানোর স্বপ্ন নিয়ে যারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন তারা মোটেও ভালো নেই। ঋণ করে বাড়তি আয়ের আশায় প্রবাসে পা রেখেছিলেন তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে, বৈশ্বিক এই মহামারি করোনা ভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সব হিসাব-নিকাশ। নিয়মিত কাজের বাইরে ওভারটাইম করে যারা বাড়তি আয় করতেন তারাও এখন বেকার। করোনায় ভেঙে গেছে প্রবাসীদের স্বপ্ন। বিশ্বজুড়ে লকডাউন এবং কর্মস্থলে স্থবিরতার কারণে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে বহুমাত্রিক সংকট দেখা দিয়েছে। 

বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা একদিকে বেতন পাচ্ছেন না আবার অনেকে ছাঁটাই ও মজুরি কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন। এরই মধ্যে দেশে ফিরেছেন কয়েক লাখ প্রবাসী। আরো কয়েক লাখ প্রবাসীর দেশে ফেরার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে। সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র বলছে, সৌদিতে কয়েকলাখ কর্মী দেশে ফিরতে হতে পারে। একই সাথে কয়েকটি দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য এমনটি জানান দিচ্ছে। লেবানন থেকে স্থানীয় সংবাদকর্মী বাবুসাহা জানান, হাজার হাজার প্রবাসী দেশে ফেরার জন্য বৈরুত বাংলাদেশ দূতাবাসে রেজিস্ট্রেশন করেছে। মধ্যপ্রাচ্য প্রায় দেশে একই চিত্র। 

তাছাড়া, বেকার হয়ে পড়ায় বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অনেকেই এখন বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না। চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে অধিকাংশই দেশে ফেরার সময় গুনছেন। বিশেষ করে এতদিন অবৈধভাবে বিদেশে আছেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যাও কম নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থা শোচনীয়। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, দুবাই, মালয়েশিয়া, ইতালিসহ কোথাও প্রবাসীদের জন্য সুসংবাদ মিলছে না।

লেখক: সাংবাদিক

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি