টাওয়ার অব লন্ডনের দাঁড়কাক
প্রকাশিত : ২০:৩৩, ১ নভেম্বর ২০২২
ব্রিটেনের অন্যতম ঐতিহাসিক পর্যটন আকর্ষণ টাওয়ার অব লন্ডন। লন্ডনের কথা মাথায় এলেই টাওয়ার অব লন্ডনের হোয়াইট টাওয়ারের ছবি চোখে ভাসবে যে কারো। লন্ডনের ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় এই ল্যান্ডমার্ক একসময় প্রাসাদ, দুর্গ, কারাগার থেকে শুরু করে চিড়িয়াখানা—কি না ছিল! বর্তমানে টাওয়ার অব লন্ডন পর্যটকদের জন্য এক বিস্ময়কর জায়গা। এখানে জুয়েল রুমে কোহিনূর হীরা বসানো রাজমুকুট থেকে শুরু করে আর্মারি জাদুঘরে বিভিন্ন সময়ে ব্রিটেনের রাজাদের যুদ্ধের পোশাক, অস্ত্রসহ নানা রকম ঐতিহাসিক জিনিস দেখার সুযোগ পান পর্যটকরা।
তবে টাওয়ার অব লন্ডনের এত এত আকর্ষণের মধ্যে একটা জিনিস বেশ অন্য রকম—এখানের দাঁড়কাক! হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত লাগলেও দাঁড়কাক এখানকার ভীষণ জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। টাওয়ার অব লন্ডনের দাঁড়কাকদের ঘিরে প্রচলিত আছে অনেক পুরনো কুসংস্কার, যা ব্রিটেনের মানুষ আজও বিশ্বাস করে।
এই তথ্যটা জানলাম কয়েক দিন আগে, যখন আমি টাওয়ার অব লন্ডনে ঘুরতে গিয়ে সেখানে কয়েকটি দাঁড়কাক দেখি। দর্শনার্থীরা দাঁড়কাকগুলোর ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন। টাওয়ারের একজন কর্মীকে দেখলাম দুটো দাঁড়কাককে কাজুবাদাম খাওয়াতে। আমাদের তাকিয়ে থাকতে দেখে সেই তরুণী কর্মী হেসে বললেন, প্রতিদিন ঘুষ দিতে হয় ওদের, যেন চলে না যায়।
টাওয়ার অব লন্ডন নির্মাণ করা হয় প্রায় এক হাজার বছর আগে। প্রথম কখন এখানে দাঁড়কাকেরা বাসা বাঁধে তা জানা যায় না। তবে এখানকার দাঁড়কাকেরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সময় থেকে, যখন রাজাকে কেউ জানায় যে টাওয়ার অব লন্ডনে যে ছয়টা দাঁড়কাক থাকে, তারা কখনো এই দুর্গ ছেড়ে চলে গেলে রাজপরিবার ও রাজত্বের পতন হবে। সে সময় এখানে বসবাস করত ছয়টা দাঁড়কাক। রাজা তখন নির্দেশ দেন, যে করেই হোক এই দাঁড়কাকগুলোকে রক্ষা করতে হবে এবং এটি নিশ্চিত করতে হবে যেন তারা টাওয়ার ছেড়ে না যায়। সেটা ১৮ শতকের গল্প। সেই থেকে এটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে টাওয়ার অব লন্ডনে সব সময় অন্তত ছয়টা দাঁড়কাক থাকতেই হবে। কেননা ব্রিটিশরা বিশ্বাস করে এই দাঁড়কাকেরা ব্রিটেনের রাজপরিবার ও রাজত্বকে রক্ষা করে।
বর্তমানে টাওয়ার অব লন্ডনে ৯টা দাঁড়কাক থাকে। তাদের মধ্যে তিনটির সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। একটি দাঁড়কাক বেশ রাজকীয়ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। একটু পর একটা ডাস্টবিনের ভেতরের পলিথিন ঠুকরে ঠুকরে ওপরে টেনে তুলল ভেতরে খাবার আছে কি না দেখতে। খাওয়ার মতো কিছু না পেয়ে আশাহত হয়ে চলে গেল।
এর কিছুক্ষণ পর এক কর্মীকে দেখলাম দুটো দাঁড়কাককে কাজুবাদাম খাওয়াতে। তাকে সেই ডাস্টবিনে খাবার খোঁজা দাঁড়কাকের কথা বলতে সে বলল, ও হ্যাঁ, ওর নাম জুবিলি। জুবিলিই একমাত্র ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে, যদিও ডাস্টবিনের খাবার সে খায় না কখনোই।
যে দাঁড়কাক দুটোকে কাজুবাদাম দেওয়া হচ্ছিল, তাদের নাম এডগার আর ব্র্যানউইন। অন্যদের তুলনায় এরা মাত্র কৈশোরে পা দিচ্ছে। এদের জন্ম গত বছরের মে মাসে এই টাওয়ারেই।
টাওয়ার অব লন্ডনের দাঁড়কাকদের থাকার জন্য বেশ বড়সড় ঘর আছে। তাদের দেখাশোনার জন্য আছেন একজন ‘র্যাভেন মাস্টার’। এই কাকেরা প্রতিদিন দুবেলা খাবার পায়। দৈনিক তারা ১৭০ গ্রাম কাঁচা মাংস খায়। তাদের খাবারের তালিকায় থাকে ইঁদুর, মুরগির ছানাসহ বিভিন্ন ধরনের মাংস। প্রতি সপ্তাহে তারা একবার মুরগির ডিম খেতে পায়। মাঝেমধ্যে তাদের আস্ত খরগোশও দেওয়া হয়।
যেহেতু এই দাঁড়কাকরা টাওয়ার ছেড়ে গেলে রাজপরিবারের পতন হবে, তাই এদের টাওয়ারে রাখার জন্য শুধু ভালো খাবারই দেওয়া হয় না, তাদের ডানার পালকও ছেঁটে রাখা হয় যেন তারা খুব দূরে উড়ে যেতে না পারে। প্রতিটি দাঁড়কাকের পায়ে আলাদা আলাদা রঙের রিং পরানো আছে, যা দেখে তাদের শনাক্ত করা যায়।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই দাঁড়কাকগুলোর প্রত্যেকের আলাদা রকম ব্যক্তিত্ব আছে। যেমন—জুবিলি ডাস্টবিন ঘাঁটতে পছন্দ করলেও অন্যরা মোটেই তা পছন্দ করে না। এই দাঁড়কাকেরা বিভিন্ন ধরনের খেলা জানে!
দাঁড়কাকদের নামে টাওয়ার অব লন্ডনে একটি গিফট শপ আর একটি রেস্টুরেন্ট আছে; এমনকি দাঁড়কাকদের নিয়ে এখানে পোস্টকার্ড, ফ্রিজ ম্যাগনেট, লকেটসহ স্যুভেনিরও আছে।
এডগার আর ব্র্যানউইনের খুনসুটি দেখে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের চেষ্টা করেছিলাম। তারা আমাকে মোটেই পাত্তা দিল না। জুবিলির সঙ্গে অবশ্য কিছুক্ষণ গল্প করতে পেরেছিলাম; এমনকি জুবিলি আমাকে তার সঙ্গে ছবিও তুলতে দিয়েছে! এমন বুদ্ধিমান আর বন্ধুবৎসল দাঁড়কাক দেখে ভেবেছিলাম, জুবিলিকে বাংলাদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাব। তবে ভেবে দেখলাম, জুবিলি চলে গেলে ব্রিটেনের রাজপরিবার, রাজমুকুট ও রাজত্বের পতন হবে। তাই দাঁড়কাকদের আমন্ত্রণ না জানিয়েই টাওয়ার
অব লন্ডন থেকে ফিরতে হলো।
কেআই//
আরও পড়ুন