ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪

ঠিক মতো ঘুম না হলে কি হয় মানুষের মস্তিষ্কে

প্রকাশিত : ১২:২৮, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

বেঁচে থাকার জন্যে আমরা যেমন খাবার খাই, নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় বাতাস নেই, ঠিক তেমনি ঠিকমতো ঘুমানোও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় আমরা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেই। কিন্তু ঘুম না হওয়া বা অনিদ্রা মানুষের মস্তিষ্কের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।

ক্রমাগত পরিমিত ঘুম থেকে বঞ্চিত হতে থাকলে খিটখিটে মেজাজ হতে পারে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ পরিমিত ঘুমের অভাবে অল্পতেই একজন মানুষ রেগে যায়।যে দিন ভালো ঘুম হয় না তা ত্বক দেখলেই বোঝা যায়। কারণ এর প্রথম দৃশ্যমান প্রভাব পড়ে ত্বকে। ঘুম ত্বকের মেরামত করে। অপরিমিত ঘুম ত্বকের লাবণ্য কমিয়ে নিষ্প্রাণ করে ফেলে।

ক্রমাগত ঘুম কম হলে ওজন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ক্রনিক অনিদ্রায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
দীর্ঘদিন ঘুমে অনিয়মের ফলে রক্তের রাসায়নিক উপাদানে পরিবর্তন ঘটে যা হাইপারটেনশনের কারণ। অপরিণত ঘুমের ফলে সৃজনশীলতা, প্রাণবন্ততা, কর্মতৎপরতা কমে যায়।

পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে খাবার হজমে সমস্যা হয়, রক্তপ্রবাহের সমস্যার কারণে স্ট্রোক ও হার্ট এর্টাকের সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণে। কেউ টানা চার দিন জেগে থাকলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে আরম্ভ করবে। আলঝেইমার্স বা স্মৃতিভ্রষ্ট্রতার অন্যতম প্রধান কারণ অপর্যাপ্ত ঘুম।

আমরা অনেকে অনিদ্রা দূর করার জন্যে ওষুধ খাই কিন্তু হাজার হাজার মেডিকেল এক্সেপেরিমেন্টে প্রমাণিত হয়েছে যে, ওষুধ খেয়ে যে ঘুম তাতে কখনো গভীর নিদ্রা হয় না। কারণ স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষের ঘুমের মধ্যে যতটা প্রশান্ত থাকে তা ওষুধ খেয়ে হয় না। কাজেই ওষুধ খেয়ে তিনি স্বাভাবিক ঘুমের উপকার থেকে বঞ্চিত হন। তার ভেতরে অস্থিরতা, খিটখিটে মেজাজ ও শারীরিক দুর্বলতার লক্ষণগুলো দেখা যায়।

গভীর ঘুমের ক্ষেত্রে অন্তরায়গুলো কী কী ?

চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, আগে মনে করা হতো, পারিবারিক বা পেশাগত কারণে যতটা ঘুম ডিসটার্বড হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ডিজিটাল পর্দার প্রভাবে। একজন মানুষ যদি দিনে দুই হাজার বার স্মার্টফোন টাচ করে তাহলে তার ঘুম আসবে কীভাবে?

আমরা সবাই আজ চারকোণা স্ক্রিনের দুনিয়ায় বন্দী। সারাদিন পর বাড়িতে ফিরে রাত জেগে বা গভীর রাত অবধি টিভি, ট্যাব, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোনের সামনে না বসে আমরা রিল্যাক্স করতে পারি না। বাড়ির মা-বাবা থেকে ছোট্ট শিশু সন্তান সবাই যার যার ডিভাইস নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আমরা জানি, ভোগবাদী পুজিঁপতিরা নিত্যনতুন ইলেক্ট্রনিক পণ্যের মাধ্যমে আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টায় তৎপর। কোনোরকম রাখঢাক না রেখে নেটফিক্স নামক সাইটটি ঘোষণা করেছে তাদের ব্যবসায়ের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী/ শত্রু মানুষের ঘুম। তারপরও আমরা রাত জেগে এসব সাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতেই বেশি ভালবাসি।

ব্রেনের মেডুলা ও মিডব্রেনের মাঝখানে রয়েছে আমাদের ওয়েকিং সেন্টার বা জাগৃতি কেন্দ্র। জাগৃতি কেন্দ্র যখন কাজ করে তখন আমরা জেগে থাকি। আর এ কেন্দ্রটি যখন কাজ বন্ধ করে দেয়, তখন আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। জাগৃতি কেন্দ্রের কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় হরমোন সংকেত দ্বারা। আর এই হরমোন নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় শরীর মনের অবস্থা দ্বারা। শরীর মনের অবস্থা অনুসারে হরমোনের মাত্রা কমতে কমতে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় এলে জাগৃতি কেন্দ্র কাজ বন্ধ করে দেয়, ফলে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু ডিজিটাল পর্দা, অর্থাৎ টিভি, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ আমাদের শরীরের এই হরমোনের মাত্রা কমতে দিচ্ছে না। আমাদের ব্রেনকে ক্রমাগত জেগে থাকার উদ্দীপনা দিচ্ছে। ফলে ব্রেনের কাজ বন্ধ হচ্ছে না এবং আমরা ঘুমাতেও পারছি না।

এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক রাতে টেলিভিশন, কম্পিউটার বা সেলফোন মনিটরে তাকিয়ে থাকা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। কারণ টেলিভিশন, কম্পিউটার বা সেলফোন মনিটরে যে নীল আলো থাকে, তা চোখের রেটিনার মাধ্যমে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে চলে গিয়ে মেলাটোনিন নামের রাসায়নিক নিঃসরণে দেরি করিয়ে দেয়। মেলাটনিন যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ নিঃসরিত না হয় তাহলে গভীর ঘুম হয় না।

ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, পড়ার সময় পড়া, ঘুমানোর সময় ঘুমানো, খেলার সময় খেলা করতে হবে। আমাদের জীবনে এখন কোনো রুটিন নেই। একেক দিন একেক সময় ঘুমাতে যাচ্ছি, একেক সময় ঘুম থেকে জাগছি। সময়ের কাজ সময়ে করতে পারছি না।

অনেকে বলেন ক্রমাগত রাত জেগে সয়ে গেছে অর্থাৎ তার কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, ক্ষতি যা হওয়ার তা ঠিকই হচ্ছে, হয়তো আপনি টের পাচ্ছেন না। পানশালায় বসে থাকা একজন মাতাল ড্রাইভার যেমনি গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বলে, আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হবে না। কিন্তু আপনি জানেন, তার অবস্থা ভালো নয়, এ অবস্থায় তাকে গাড়ি চালাতে দেয়া যাবে না।
ঘুমোনোর স্বাভাবিক নিয়ম : আসলে ২৪ ঘণ্টায় কতটা সময় ঘুমাবেন ব্যক্তিভেদে এটা নির্ভর করে। কারো ৬ ঘণ্টা ঘুমিয়ে দিব্যি কেটে যায় আবার কারো ক্ষেত্রে ৭-৮ ঘণ্টা। কতক্ষণ ঘুমের প্রয়োজন এটা নির্ভর করে ব্যক্তির দেহঘড়ির ওপর। তার খাদ্যাভ্যাস, হরমোন প্রবাহ, পরিবেশ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। যারা মেডিটেশন করেন তারা আধাঘণ্টা মেডিটেশন করে দুই ঘণ্টা সমপরিমাণ ঘুমের এনার্জি লাভ করে। রেম ঘুম বা গভীর ঘুম, এটার একটা চক্র আছে, ১.৫ ঘণ্টায় এক চক্র পূর্ণ হয়। আমরা চেষ্টা করব, ৩ চক্র, ৪ চক্র অর্থাৎ ৪.৫ ঘণ্টা, ৬ ঘণ্টা এভাবে ঘুমাতে। তাহলে ঘুম থেকে ওঠার পর ক্লান্তি থাকবে না।

মহামতি বুদ্ধের জীবনে একটি ঘটনা আছে। বুদ্ধের সাথে কয়েকজন সাধনা শুরু করেছিলেন। বুদ্ধ দিনের কিছু সময় ঘুমিয়ে কাটালেন, খিদে পেলে ফলমূল খেতেন। তার সাথের সাধকরা মনে করলেন যে, বুদ্ধকে শয়তান ধরেছে, তার সিদ্ধি লাভ সম্ভব নয়, তার সাথে থাকলে তারাও শয়তান দ্বারা আক্রান্ত হবো। তাই তাকে ছেড়ে তখন চলে গেলেন। কিন্তু তারা কেউই সিদ্ধি লাভ করতে পারেন নি। পেরেছিলেন একমাত্র বুদ্ধই। কারণ তিনি জানতেন যে-কোনো কাজে সফল হতে গেলে শরীরের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। তাই তিনি সাধনার পাশাপাশি পরিমিত পরিমাণ খেতেন এবং ঘুমাতেন।

তবে কেউ যদি আবার মনে করে বসেন বেশি ঘুমালে শরীর বেশি ভালো থাকবে, তাহলে সেটিও ভুল। গবেষণায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অতিরিক্ত ঘুমের সাথে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও অপরিণত বয়সে মৃত্যুর সাথে সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। সাধারণত যারা একটু আলসেমি করতে পছন্দ করেন কিংবা হতাশায় ভুগছেন তারাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমান। অতিরিক্তি ঘুম শুধু দেহের নয়, আত্মারও মৃত্যু ঘটায়।

টিআর/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি