ঢাকা, মঙ্গলবার   ২২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

ডি সিলভা সাহেবের কথা

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৮:১১, ২৬ মে ২০২০ | আপডেট: ১৮:৪৩, ২৬ মে ২০২০

ছবি: বরিশালের ব্যাপ্টিস মিশন গীর্জা।

ছবি: বরিশালের ব্যাপ্টিস মিশন গীর্জা।

Ekushey Television Ltd.

ডি সিলভা সাহেবকে আমি প্রথম দেখি ষাটের দশকের প্রথমার্ধে। তাঁকে মূলত: দেখা যেত বরিশালে শহরের সদর রোডের নানান জায়গায়। কাজেই আসতেন তিনি। প্রায়ই দেখতাম, তাঁর কালো মরিস মাইনর গাড়িটা সরদার চাচার দোকানের সামনে রেখে তিনি এদিক-ওদিক যেতেন। সরদার চাচা মানে মোহাম্মদ আলী সর্দার - যাঁর একটি দর্জীর দোকান ছিল অশ্বিনী কুমার টাউন হলের পাশের বিপনী বিতানে। নাম ছিল সম্ভবত: ন্যাশনাল টেইলারিং। এর ওপর দিকের তলাতেই পরবর্তীকালে তৎকালীন বরিশালের বিলাসী হোটেল গুলবাগ গড়ে ওঠে।

মাঝে মাঝে ডি সিলভা সাহেব থেকে গাড়ির দরজার চাবি আটকে সর্দার চাচার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন। দোকানের সামনের দিকে চাচার কাপড় কাটার টেবিল। কাপড় কাটতে কাটতে সর্দার চাচা ডি সিলভা সাহেবের সঙ্গে গল্প করতেন। সর্দার চাচার মুখ ভর্তি থাকতে পান, দাঁড়ি কামাতেন সম্ভবত: একদিন, হাল্কা করে গিট্টু দেয়া লুঙ্গি মাটিতে লুটাতো। কিছুটা গল্পের পরেই জি সিলভা হাঁটা দিতেন তাঁর ব্যাংকের দিকে। অশ্বিনী কুমার টাউন হলের একটু কোনাকুনি উল্টো দিকে একটি হলুদ দোতলা বাড়ির ওপরে ছিল ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশনের অফিস। সবুজ খড়খড়ির জানালা, প্রশস্ত মার্বেলের সিঁড়িসহ মজবুত সেগুন কাঠের দরজা। 

বেশ ভারী চর্বিবহুল শরীর ছিল তাঁর, তার মধ্যে বেশ ছোটখাটো ছিলেন মানুষটি। আমার ধারনা আশির ওপরে বয়েস ছিল ডি সিলভা সাহেবের। মুখের সব বলিরেখা স্পষ্ট, চামড়া ঝুলে গেছে। প্রচণ্ড ঢোলা ঘিয়ে প্যান্টের সঙ্গে ততোধিক ঢোলা হাফসার্ট প্যান্টের মধ্যে ঢুকিয়ে পরতেন তিনি। বেল্ট নয়, সাসপেন্ডার দিয়ে প্যান্ট আটকে রাখতেন তিনি। পায়ে কেডসের জুতো, মাথায় সেকালের শোলার হ্যাট। তবে সবচেয়ে দর্শনীয় ছিল তাঁর হাঁটাটি। ঠিক হাঁসের মতো দু’দিকে দুলে দুলে হাঁটতেন তিনি। দেখলে মনে হতো, একটি হাঁস হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো মোটা শরীরে এ ছাড়া ভারসাম্য রক্ষার অন্য কোন উপায় ছিল না তাঁর।

তাঁকে আমি সামনা-সামনি দেখেছি ঐ ইস্টার্ন ব্যাংকিং করেপোরেশনের দপ্তরে। ঐ অতো ছোটবেলাতেও (আমার বয়স তখন ১২/১৩ বছর), বাবা আমাকে ব্যাংকে পাঠাতেন মূলত: তাঁর চেক জমা দিতে। আমি ম্যানেজার সাহেবের ঘরে ঢুকে বসতাম। ম্যানেজার সাহেব হাতের কাজ সেরে চেক জমা নিতেন। আমার জন্যে আসতো ছোট্ট করে এক কাপ ঘন দুধ চা। অমন স্বাদের চা খুব কমই খেয়েছি। আমি চা খেতে খেতে ডি সিলভা সাহেব ম্যানেজার সাহেবের ঘরে ঢুকতেন। দেখতাম সোজা বরিশালের ভাষায় কথা বলতেন ডি’ সিলভা। চা আসতো তাঁর জন্যেও। একদিন কথা প্রসঙ্গে ম্যানেজার সাহেব আমার পরিচয় দিয়েছিলেন ডি’সিলভার কাছে। দেখা গেল, তিনি বাবাকে চিনতেন।

কোন কোন দিন তাঁকে ঢুকতে দেখেছি দীপালি হেয়ার কাটিং সেলুনে। বরিশালের ঐ অভিজাত সেলুনের দরজায় মার্কিনি পশ্চিমা ছবিতে দেখা শুঁড়িখানার দরজায় ছোট দরজাঝুলনের মতো কঙীন ফুল আঁকা ঘসা কাঁচের দরজাঝুলন ছিল। সেই সেলুনে কখনো চুল কাটাতে পারিনি। আমার ভরসা ছিল নতুন বাজারে সুরেশদার নিউ হেয়ার কাটিং সেলুন। যতদূর মনে পড়ে দীপালি সেলুনের পাশেই ছিল এডভোকেট উপেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জ্জীর চেন্বার, যাঁর পুত্র পার্থসারথি চ্যাটার্জি ভালো আবৃত্তি, বক্তৃতা ও বিতর্ক করতো বলে মনে পড়ে।

যদ্দূর মনে পড়ে, সাগরদী এলাকায় তাঁর পেল্লায় এক বাড়ি ছিল। বাবা একদিন রিক্সা দিয়ে যেতে যেতে দেখিয়েছিলেন বাড়িটি। আবছা স্মৃতি আছে একটু একটু যে, বাড়িটি ছিল লালচে রঙ্গের দোতলা। তবে বহু বছর আগ তো, স্মৃতি অবশ্যই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।

একটি কিশোর হৃদয়ে কেন জানি, ডি সিলভা সাহেব জায়গা করে নিয়েছিলেন। নানান প্রশ্ন আমার মনে খেলা করত। সেই সুদূর পর্তুগালের এ বৃদ্ধ মানুষটি কেমন করে বরিশালে এলেন? তাঁর বাবাও কি এখানে ছিলেন? কে কে আছে ডি সিলভার? কোথায তাঁর জমিদারী ছিল? কিসের টানে তিনি বরিশালের মতো শহরে থেকে গেলেন? কেমন করে তিনি মিশে গেলেন আমাদের এই শহরের সঙ্গে? কখনো-সখনো এও মনে হত যে, আচ্ছা, ডি সিলভার মৃত্যু হলে কি হবে?

ক’দিন আগে Benjamin Kingsbury র বই ‘An Imperial Disaster : The Bengal Cyclone of 1876 পড়ছিলাম। বইটির এক জায়গায় এসে থেমে গেলাম। পটুয়াখালীর গলাচিপা অঞ্চলে এ্যান্থনী ডি’সিলভা বলে একজন জমিদারের কথা বলা হয়েছে সেখানে, যিনি পর্তুগীজ ব্যবসায়ীদের বংশধর। হঠাৎ করে কেন জানি এবং কেমন করে জানি, আমার ছোটবেলায় দেখা ডি’ সিলভা সাহেবের কথা মনে পড়ে গেলো। হয়তো আমার ডি’সিলভা ঐ এ্যান্থনী ডি’ সিলভার বংশধর - কে জানে?

পাদটীকা: বেশ ক’বছর আগে আমার ছোটবেলায় বরিশালে দেখা এক পর্তুগীজ জমিদারের কথা বলেছিলাম আমার বাল্যসহপাঠী জাহীদের (জাহীদ হোসেন চৌধুরী) কাছে। কিন্তু আমি তাঁকে উল্লেখ করেছিলাম পেরেরা সাহেব বলে। পেরেরা রোজের দীর্ঘদিনের অধিবাসী জাহীদ আমাকে শুধরে দিয়েছিল এই বলে যে, পেরেরা সাহেবকে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ তিনি গত হয়েছেন আমার জন্মের বহু আগে। আমি যাঁকে দেখেছি, তিনি ডি’ সিলভা। ধন্যবাদ, এ কৃতজ্ঞতা জাহীদকে।

লেখক- বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও কলামিস্ট।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি