ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

ইরান-জর্ডান থেকে অস্ত্র পাকিস্তানে

ঢাকার আকাশ মিত্রবাহিনীর দখলে

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ০৮:৩০, ১০ ডিসেম্বর ২০২১ | আপডেট: ০৯:৩১, ১০ ডিসেম্বর ২০২১

বোমা আর রকেট হামলায় স্তব্ধ হয়ে গেলো ঢাকা বেতার কেন্দ্র। ঢাকার আকাশটা আজ মিত্রবাহিনীর দখলে। বিধ্বস্ত হয়ে গেলো কুর্মিটোলা বিমানবন্দর।

বিমান হামলায় অচল চট্টগ্রাম বন্দর। ওদিকে জাহাজে চেপে পাকিস্তান বাহিনী পালিয়ে যাবার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে। এমন দিনে মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধ সত্ত্বেও ইরান ও জর্ডান থেকে অস্ত্রের চালান পৌঁছে যায় পাকিস্তানে।

বঙ্গোপসাগরের দিকে ভেসে আসতে থাকে আণবিক অস্ত্র বোঝাই রণতরী ‘এন্টারপ্রাইজ’। এন্টারপ্রাইজের পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন হেনরি কিসিঞ্জার। যদিও এখনো আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টকে কিছু বলা হয়নি।

এমনকি নৌবহরের কমান্ডার এলমো জামভালটও কিছু জানতেন না। জাতিসংঘ প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলীকে একটা বার্তা পাঠালেন।

বললেন, ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং পাকিস্তান বাহিনীকে নিরাপদ হস্তান্তরে জাতিসংঘের সাহায্য চাই।’ পাকিস্তান সৈন্যর শিরদাঁড়া ভেঙে যাওয়া অবস্থায় সন্মানজনকভাবে সৈন্য প্রত্যারের জন্য উদ্যোগী নিক্সন সরকার।

আজ, সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্রেজনেভকে দুই দফা বার্তা পাঠালেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। কারণ একটাই, নিক্সনের কানে পৌঁছে গেছে ভারতীয় নৌসেনা মেঘনা অতিক্রম করছে। এখনো সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌঁছতে আরো চারদিন লাগবে। এই সময়টা নিতে চান নিক্সন।

তাই, ব্রেজনেভ ভারতকে চাপ দেয়, যেন ভারতীয় নৌসেনারা মেঘনা থেকে আর না এগিয়ে আসে। কিংবা ফিরে যায়। ভারত তাদের নৌসেনা ফিরিয়ে নিলে, শর্ত ছাড়াই যে যেখানে আছে সেই ভিত্তিতে কেবল ’নিশ্চল যুদ্ধবিরতি’ সম্ভব। তাই, ব্রেজনেভেনের সাহায্য চান নিক্সন। নিক্সনের পর কিসিঞ্জার।

সোভিয়েত প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে পড়ে শোনালেন ১৯৬২ সালের স্মারকলিপি। ভারতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সাহায্য করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার। কিসিঞ্জার বললেন, এই অঙ্গীকার রক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত দৃঢ় আমেরিকা সরকার। সিআইএ-র গোপন প্রতিবেদন সাথে নিয়ে জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া-র সঙ্গে কথা বললেন কিসিঞ্জার। মনে করিয়ে দিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের ধ্বংসের পেছনে ভারতের পরিকল্পনা।

মোটকথা সোভিয়েত-ভারত সম্পর্কের শাক্তি সম্পর্কে চিন্তিত আমেরিকা-চীন। আজ, তৃতীয় বারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানিয়ে দিলেন কিসিঞ্জার, ভারতকে যুদ্ধবিরতিতে যদি রাজি করানোর বিষয়ে দ্রুত সন্তোষজনক উত্তর না পাওয়া যায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর ‘শক্ত ব্যবস্থা’ গ্রহণ করবে। পাকিস্তানকে রক্ষা করতে কোমর বেঁধে নেমেছে ওয়াশিংটন।

মরিয়া পাকিস্তানি সেনা। পথে-ঘাটে যেখানে যাকে পাচ্ছে তাকেই হত্যা। আজ বহু নিরিহ মানুষের প্রাণ যায় পাকিস্তানের বোমা আর বুলেটে। থেমে নেই মুক্তি-মিত্র’র আক্রমন। রাজধানী ঢাকা ছাড়া দেশের বেশিরভাগ জেলা এখন শত্রুমুক্ত।

ঢাকায় চূড়ান্ত হামলা চালিয়ে শত্রুদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করাতে এগিয়ে যাচ্ছে মিত্রবাহিনী। ঢাকায় চলছে কারফিউ আর ব্ল্যাক আউট।

ময়মনসিংহ শহরের ডাকবাংলো, কোওয়াটখালি, বড়বাজার, নিউমার্কেট, কালীবাড়ি ও সাহেবআলি রোড এলাকায় বহু নিরীহ সাধারণ মানুষ হত্যা করে পকিস্তানি সৈন্য। হেলিকপ্টার এবং স্টিমারে মেঘনা নদী পেরিয়ে মিত্রবাহিনী ভৈরব বাজারে ঘাঁটি থেকে এগিয়ে আসছে ঢাকার দিকে।

সম্মিলিত বাহিনীর গোলার মুখে পাকিস্তানি সেনারা মেঘনার তীরে মুক্তি-মিত্র বাহিনীর গতি আটকে দিতে পারলো না। বাইরে থেকে পাকিস্তানি সেনারা যেন ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য নদীপথে তাদের যতগুলো স্টিমার-গানবোট এগোনোর চেষ্টা করেছে সবগুলিই মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় তছনছ।

পাকিস্তানি সেনার পরাজয় এখন কেবল সময়ের বিষয়। অবস্থা বুঝতে পেলে লেজ গুটিয়ে পালানোর চেষ্টা করছেন লে জে নিয়াজি। এই খবরটি প্রচার করলো বিবিসি। সন্ধ্যার পর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে নিয়াজি বেশ উচ্চস্মরে বললেন, ‘কোথায় বিদেশি সাংবাদিকরা, আমি তাদের জানাতে চাই, আমি কখনো আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাব না।’

এদিকে মুক্তির-যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা উত্তরাঞ্চলে। মুক্তি-মিত্র বাহিনীর যৌথ অভিযানে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের থাকা পাকিস্তানি সেনাদের পরস্পরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ২ আজ, ১০ ডিসেম্বরে ঘটলো মর্মান্তিক ঘটনা। খুলনার রূপসায় রূপসা নদীতে নৌবাহিনীর জাহাজ ‘পলাশ’ রওনা দিয়েছে খুলনার উদ্দেশে। এমন সময় হঠাৎ, ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ‘ভুল বোঝাবুঝির যুদ্ধ’।

গোলার আঘাতে শহীদ হলেন রুহুল আমিন। যাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ সন্মানে ভুষিত করে। রাতের অন্ধকারে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, পিপিআই সংবাদ সংস্থার প্রধান সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন, সৈয়দ নাজমুল হককে আলবদর-আলশামস বাহিনী বাসভবন থেকে অপহরণ করে। এরপর এই তিনজনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি