ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য চুরির মধ্যে পার্থক্য কী

ড. সেলিম মাহমুদ

প্রকাশিত : ২০:৫৮, ১৯ মে ২০২১

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে বিরাজমান সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকের স্বাধীনতার সামগ্রিকতাকে আড়াল করে সাংবাদিক রোজিনার বিষয়টি নিয়ে একটি মহল যেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং দেশে-বিদেশে এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেভাবে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে, তাতে মনে হচ্ছে এটি একটি নতুন ষড়যন্ত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে কেও কেও এমনভাবে মন্তব্য করছেন যেন রাষ্ট্র সাংবাদিকগণের বিরুদ্ধে বিমাতা সুলভ আচরণ করছে। সাংবাদিক রোজিনার বিষয়টি নিয়ে কেও কেও ধুম্রজাল তৈরী করার চেষ্টা করছে। এই বিষয়ে কে অপরাধী, কে অপরাধী নয় - আমি এটি নিয়ে কোন মন্তব্য করবো না। এটি এখন একটি বিচারিক বিষয়। তবে আমাদের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও নীতি- নৈতিকতার আলোকে রাষ্ট্রীয় কোন তথ্য জানার বা সংগ্রহ করার বিষয় নিয়ে কিছু বলবো।

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, জননেত্রী শেখ হাসিনার কারণে আজ বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকগণ অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছেন। তিনিই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। দেশে এতোগুলো প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অনুমোদন তিনিই দিয়েছেন। সাংবাদিকগণের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি ভীষণভাবে সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল। এই বিষয়গুলো নতুন করে বলার দরকার নেই। এইসব বিষয় আমরা সবাই জানি। 

তবে কিছু মৌলিক বিষয়ে আমাদের আরও ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে তথ্য অধিকারের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ সংসদে প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী স্বাধীন তথ্য কমিশন তিনিই গঠন করেছিলেন। সেই সামরিক সরকারের সময় থেকে এই ধরণের একটি কমিশনের কথা অনেকেই বলে আসছিল। শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া কোন সরকারই এটি করার উদ্যোগ নেয়নি। তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক সহ সকলেরই তথ্য জানার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অনেকেই এটি করছেন না। অনেকেই বুঝে বা না বুঝে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট নিয়ে কথা বলছেন। ১৯২৩ সালে প্রবর্তিত এই আইন উপমহাদেশের সকল দেশ সহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিদ্যমান রয়েছে। আওয়ামী লীগের বাইরে কোন সরকারের সময় এই আইন নিয়ে কথা হয়নি। শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই সকল বিষয় কেন আনা হয়? 

তথ্য সংগ্রহ আর তথ্য চুরির পার্থক্যটা আমাদের বুঝতে হবে। তথ্য চুরি করা একটি অপরাধ। আমাদের মনে রাখতে হবে, তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি পৃথিবীর সকল দেশেই সংবিধান এবং আইনের আওতাধীন। সংবিধান এবং আইন মেনেই সকল দেশে সরকারী বা রাষ্ট্রীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। পৃথিবীর কোথাও রাষ্ট্রীয় বা সরকারী তথ্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় না।  এটি সবসময়ই নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গণমাধ্যমকেও কিছু বিধি নিষেধ মেনে নিয়ে কাজ করতে হয়। একটি বিষয় আমরা অনেকেই খেয়াল করিনা, আমাদের সংবিধান সহ পৃথিবীর সকল দেশের সংবিধানে গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট (basic feature of the constitution)। কারণ সংবিধান অনুযায়ী (সংবিধানের তৃতীয় তফসিল অনুযায়ী), মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী দুইটি শপথ পাঠ করেন। একটি সাধারণ শপথ অর্থাৎ আনুগত্য ও সংবিধান রক্ষার শপথ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে গোপনীয়তার শপথ। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কার্যাবলীর গোপনীয়তা রক্ষা করা একটি সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে সকল বিষয় আসে, সেগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে আসে। এই সকল মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের নথিগুলোতে এই সকল তথ্য থাকে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য সকল মন্ত্রীগণ সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিচ্ছে, তাদের সামনে উপস্থাপিত সকল বিষয়ের গোপনীয়তা তাঁরা রক্ষা করবেন, সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে সেই তথ্য গুলো যখন কেও প্রকাশ করে দেয় কিংবা কেও যখন এই তথ্য চুরি করে, এটি শুধু চুরিই নয়, এটি সংবিধানেরও লংঘন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সরকারী তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। সাংবাদিক সহ যেকোনো ব্যক্তি তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করবেন। তথ্য পেতে কোন প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হলে তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা আছে। তবে একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, সংবিধানে গোপনীয়তা রক্ষার যে বিষয়টি রয়েছে, সেটি অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ নেই। সেটি মেনেই আমাদের তথ্য অধিকারের বিষয়টি দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রীয় অনেক তথ্যই মূল্যবান এবং এগুলোর সাথে রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত থাকে। অনেক তথ্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সম্পর্কিত, অনেক আর্থিক ও অর্থনৈতিক তথ্য থাকে যেখানে জাতীয় স্বার্থ জড়িত। বাজেটের বিভিন্ন তথ্য, স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য, টেন্ডার সম্পর্কিত, জ্বালানী তেলের মুল্য, অর্থ মন্ত্রনালয়ের নানা তথ্য এবং রাষ্ট্রীয় আরও অনেক তথ্য থাকে যেগুলোর বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ঐ তথ্য গুলো প্রকাশিত হলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে। এই কারণে পৃথিবীর সকল দেশেই রাষ্ট্রীয় নতি গুলোকে ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট হিসেবে দেখা হয়। 

আমাদের দেশের সচিবালয় সহ সরকারী দপ্তরগুলোতে সাংবাদিকগণ যেভাবে অবাধে তথ্য সংগ্রহ করেন, পৃথিবীর আর কোন দেশে সাংবাদিকগণ এতোটা স্বাধীনতা ভোগ করেন না। তথ্য সংগ্রহের জন্য তথ্য চুরি করা শুধু অপরাধই নয়, এটি সংবিধানেরও লংঘন। সরকারী দপ্তরের কোন কর্মকর্তার নথি থেকে গোপনে কাগজ পত্র সরিয়ে নেয়া কিংবা গোপনে ছবি তুলে নেয়া তথ্য চুরির মধ্যে পড়ে। এই ধরণের অনৈতিক ও বেআইনি কাজ সাংবাদিকতার নীতি বিরোধী। সাংবাদিক অবশ্যই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করবেন। তার জন্য তথ্য চুরি করার প্রয়োজন হয় না। একজন পরিশ্রমী সাংবাদিক চাইলে মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী, সচিব সহ বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন, পলিসি, রেগুলেটরি আদেশ, মন্ত্রী পরিষদ ও আন্তঃমন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ইত্যাদি সম্পর্কে নিয়মিত স্টাডি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় বা দপ্তরের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করলে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়া, সাংবাদিকগণ মন্ত্রনালয় সমুহের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং এ অংশ নেন। সেখানে তাঁরা মন্ত্রী সচিবকে প্রশ্ন বানে জর্জরিত করতে পারেন। তারপরও কোন সাংবাদিক সন্তুষ্ট না হলে তিনি মন্ত্রী, সচিব সহ অন্যান্য কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে তাঁর সাথে খোলা মেলা আলাপ করে বিষয় গুলো জানার চেষ্টা করতে পারেন। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে একজন সাংবাদিক ঐ মন্ত্রনালয়ে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে বুঝতে পারবেন এবং তিনি এই অনিয়মের কথা লিখতে পারবেন। আমাদের দেশের অধিকাংশ সাংবাধিকই এই ধরণের পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং তাঁরা সত্যিকার অর্থে মেধাবী ও পরিশ্রমী সাংবাদিক। কিন্তু সরকারী দপ্তর থেকে তথ্য চুরির বিষয়টি একদিকে যেমন একটি অপরাধ, অন্যদিকে এই প্রবণতার কারণে সরকারী দপ্তর গুলোর কিছু কর্মকর্তা- কর্মচারী তথ্য চুরির বিষয়টির সাথে যুক্ত হয়ে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে দেশের অনেক ক্ষতি করতে পারে। দেশী বিদেশী কিছু ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটও  তথ্য চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট এই গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে নানা অবৈধ স্বার্থ হাসিল করতে পারে। তাই তথ্য চুরির বিষয়টিকে হাল্কা ভাবে দেখা ঠিক হবে না ।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা কেওই আইনের উর্ধে নই। কেও অপরাধ করলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে। আবার, কেও যাতে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় সেটিও সবাইকে দেখতে হবে। সাংবাদিক রোজিনার বিষয়টি নিয়ে দেশে বিদেশে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, আমার কাছে মনে হয় এটি একটি নতুন ষড়যন্ত্র। যারা সরকারের এক যুগ ধরে নিরবিচ্ছিন্ন সাফল্য আর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারছে না, তারাই মূলত এই ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছে। এই বিষয়ে আমাদের সবাইকে একটু সতর্ক থাকতে হবে।

এসি
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি