তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা
প্রকাশিত : ১৮:৪৬, ৩০ নভেম্বর ২০১৮
(ফাইল ফটো)
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অধিকাংশের বয়স ত্রিশের নিচে। অর্থাৎ জনসংখ্যার অধিকাংশই তরুণ। এবারের নির্বাচনে ১০ কোটি একচল্লিশ লাখ ভোটারের ভেতর নতুন ভোটার ৪৩ লাখ। আঠারও থেকে আঠাশ বছর বয়সের ভোটার অর্থাৎ তরুণ ভোটার ২ কোটি ১৫ লাখ, যা মোট ভোটারের ২০.৬৫%। (তথ্য সূত্র : ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ০১/০২/২০১৮)। যে কোন দেশের নির্বাচনের মাপকাঠিতেই এটা এক বিশাল অংক। সুতরাং সব দল ও প্রার্থীর কাছে এই বিশাল ভোট ব্যাংক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এদের মন জয় করার চেষ্টাই হবে প্রার্থীদের প্রধানতম কাজগুলোর একটি, তা বলাই বাহুল্য। এই তরুণ সমাজ কি ভাবছেন সেটা শুধু দল বা প্রার্থীর কাছে নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
নিশ্চিতভাবে, একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশই হবে এই প্রজন্মের মুখ্য চাওয়া। তারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইবে, খুলে দিতে চাইবে নিজের সম্মুখের সব দ্বার, বহির্বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মাথা উঁচু করে নিজেদের স্থানটি করে নিতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য তাদের নিজেদের কি করণীয় তারা কি সেটা জানেন? সেটা নিয়ে কি তারা ভাবছেন? আমরা কি সেটা তাদের কাছে উপস্থাপন করেছি? নীতি-নির্ধারণের সময় তাদের কি আমরা যুক্ত করছি? জাতীয় জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজে তরুণদের সংযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আজ দৃষ্টি দিতে চাই আসন্ন নির্বাচনে তরুণদের কাছে জাতির প্রত্যাশার ওপর।
লেখক: ডা. নুজহাত চৌধুরী
তরুণ প্রজন্মের বিশাল ভোটে আমাদের দেশের ও সেই সঙ্গে আমাদের সকলের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে। তাই এই ভোট তারা সুচিন্তিতভাবে দিবে, তা আমরা চাইতেই পারি। এক্ষেত্রে তাদের কি করণীয় অথবা তাদের কাছে দেশ ও জাতির কি প্রত্যাশা সেটা নিয়ে কথা বলার এখন শ্রেষ্ঠ সময়। একটি ভোট শুধু একটি সরকার বদল করে না, সেই সঙ্গে একটি জাতির যাত্রার গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারে। এমনকি সম্মুখ যাত্রার পথ রুদ্ধও করে দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে হিটলারও কিন্তু জনগণের বিশাল ম্যান্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। এবং তার পরবর্তীতে শুধু জার্মানি নয়, সারা বিশ্বের কি পরিণতি হয়েছিল তা আমরা জানি। সুতরাং নিজের একটি ভোটের ক্ষমতা কত বিশাল তরুণ প্রজন্মকে তা অনুধাবন করতে হবে।
স্বয়ং এই বাংলাদেশে, ১৯৯১-এর নির্বাচনের ভোট, যুদ্ধাপরাধীদের সরকারের অংশ হওয়ার সুযোগ করে দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত পতাকা তাদের খুনীদের গাড়িতে তুলে দেওয়ার পথ খুলে দেয়। কি দুঃখজনক এই ঘটনা! শুধু এবার নয়, ভবিষ্যতে এ দেশে, আর কোন ভোট যেন তেমন ভুলের ক্ষেত্র তৈরি করতে না পারে কোন দিন, সেই জন্য আজকের তরুণদের সচেতন করতে হবে। তরুণদের জানাতে হবে তাদের হাতের একটি ভোট কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বোঝাতে হবে প্রতিটি জনগণের হাতের এক একটি ভোট, শুধু সরকার নয়, সমাজ বদলের কত বড় হাতিয়ার। তরুণদের অনুধাবন করতে হবে, দেশ স্বাধীন হওয়ার কারণেই আমাদের সকলের এত স্বপ্ন দেখার সুযোগ হচ্ছে। দেশ স্বাধীন না হলে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের পদদলিত হয়েই আমাদের থাকতে হতো– এ কথা সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। যে দেশের জন্ম ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, তার প্রতিটি উত্তর-প্রজন্মের অনিবার্যভাবে। কিছু ঋণ রয়ে যায় সেই পূর্বসূরি বীরদের রক্তের কাছে। আজকের তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে হবে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য ’৭১-এ তার পূর্বসূরি বিসর্জন করেছেন তাদের উজ্জ্বল বর্তমানকে। যে আজ যেই অবস্থানেই থাকুন, আপনার সেই অবস্থানে পৌঁছানোর সিঁড়ি অনেক প্রাণের বিনিময়ে অনেক উচ্চ মূল্যে তৈরি করা। আপনি যদি বিদেশের মাটিতে প্রবাসী হন তা হলেও সেই ঋণ আপনি আপনার রক্তে বয়ে বেড়াচ্ছেন।
মনে রাখতে হবে, বাঙালির ভোট দিয়ে নিজ ভাগ্য গড়ার এই সুযোগ লাভ, সেটাও এত সহজলভ্য ছিল না। দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করেও বাঙালি নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার সুযোগ পেল না। সেই সুযোগ পাওয়ার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জন্য আমাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এটা কত বড় একটি বিষয়। শুধু ইতিহাস পাঠ করলেই এর মর্মার্থ বোঝা যাবে না। এটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে। বুঝতে হবে কত ত্যাগে পেয়েছি একটি ভোট দিয়ে নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার এই অমূল্য সুযোগ।
শুধু কি তাই? স্বাধীনতার পরও বার বার সামরিকতন্ত্রের বুটের আঘাতে ও স্বৈরতন্ত্রের আক্রমণে পরাস্ত হয়েছে গণতন্ত্র। ’৯০-এ আবার দিতে হয়েছে গণতন্ত্রের দাম নূর হোসেন, জাহাঙ্গীর, দীপালি সাহাদের রক্তে। এভাবেই বাঙালি বার বার হারিয়েছে গণতন্ত্রের সুযোগ আর বার বার রক্ত দিয়ে এই অধিকার আদায় করেছে। তাই ভোটের অধিকার আমাদের পবিত্র আমানত। এর যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে আমাদের সবাইকে।
তরুণ প্রজন্মকে তাই সঙ্গতভাবেই ভাবতে হবে, কিভাবে তারা তাদের হাতের ভোটটির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারেন। এর স্পষ্ট উত্তর-পূর্বপুরুষের রক্তের প্রতি অনুগত থেকে ভোট দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে আজীবন থাকতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে শোষণহীন, বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল দেশের স্বপ্ন দেখে আমাদের স্বজনরা অকাতরে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, সেই আদর্শই আমাদের পথ চলবার বাতিঘর হয়ে থাকতে আজীবন। এর থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না কখনই কোন কারণেই। এই আদর্শের ভেতরেই থাকতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে।
বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে সব দলকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধীরা তো নয়ই, তাদের সহযোগী কেউই এদেশে রাজনীতি যেন করতে না পারে, সেই দিকে তরুণদের সচেষ্ট হতে হবে। যেই সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, ধর্মের অপব্যবহারকারী অপরাজনীতির কারণে পরাজিত দেশবিরোধী শক্তিরা স্বজাতির ওপর আঘাত হেনেছিল, সেই অপরাজনীতি যেন এদেশে আর ঠাঁই না পায়। মনে রাখতে হবে, এই দেশে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের চক্রান্ত কিন্তু চলমান। এই চক্রান্তের গভীরতা, নিষ্ঠুরতা ও ব্যাপকতা অনুধাবন করতে হবে। দেশের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে এই চক্রান্তের ভয়াবহতাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সকলে সম্মিলিতভাবে এর মোকাবেলা করতে হবে। দেশবিরোধীদের সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই সময় আমাদের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে ভোট দেওয়া।
কোন ক্ষুদ্র কারণেই আমাদের বিভাজিত হওয়া যাবে না। ব্যক্তিগত ক্ষোভ থাকতে পারে, দলীয় কাজে অসম্মতি থাকতে পারে কিন্তু মনে রাখতে হবে সামগ্রিক পরিস্থিতি কি। সামনের নির্বাচন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির টিকে থাকার লড়াই। এই লড়াইয়ে অতি বিপ্লবী আচরণের কোন সুযোগ নাই। অতিরিক্ত উচ্চমার্গের অবাস্তব আদর্শিক স্বপ্ন দেখার বা বাছ-বিচার করার সময় এটা নয়। থাকতে হবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে তরুণদের জন্য এটাই স্পষ্ট হিসাব।
একজন শহীদ সন্তান হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যুদ্ধাপরাধীদের দল বা তার সহযোগীদের বাক্সে নিজের পবিত্র আমানত হাতের ভোটটি তুলে দিয়ে, তারুণ্য তার রক্তের ঋণের সঙ্গে বেইমানি করবে না, তারুণ্যের দ্রোহের যে গর্ব তাকে অপমান করবে না। তাই আমি দুই একটা স্লোগান এখানে উচ্চারণ করব, যা এখন খুব উচ্চারিত হচ্ছে রাজপথে ও ভার্চুয়াল মিডিয়াতে যা আমার মনে হয়েছে তরুণদের জন্য খুব প্রযোজ্য। উচ্চারিত হচ্ছে, ‘তরুণ ভোটার প্রথম ভোট, স্বাধীনতার পক্ষে হোক’। স্লোগান উঠেছে, ‘আমার ভোট আমি দেব, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেব।’ আমার মনে হয় এই স্লোগান দুটোতে স্পষ্ট বলে দেওয়া আছে তরুণদের প্রতি জাতির আকাক্সক্ষার কথা।
শুরু করেছিলাম এই বলে যে, তরুণদের মুখ্য চাওয়া একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। তারা দেশের উন্নয়ন চায়, নিজে উন্নতি করতে চায়। সেক্ষেত্রে, দেশ সমৃদ্ধশালী হবার জন্য উন্নয়নের যে মহা কর্মযজ্ঞ চলছে দেশে, তার গতি যদি ধরে রাখতে চাই তবে, এই সুযোগ ও সময় এই সরকারকে দিতে হবে। একটি সরকারের সব কাজ সঠিক হওয়া সম্ভব না, সরকারের সব কাজ ভালো লাগারও কথা না, সবার সব দাবি মানাও সম্ভব না। বিচার করতে হবে সরকার তাদের সময়কালে দেশের উন্নয়নে যথেষ্ট কাজ করেছে কি-না। তার চেয়েও তরুণদের জন্য সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হতে হবে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কারা তাকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, কারা দিচ্ছে সামনে পথ চলার দিক নির্দেশনা। ২০২১, ২০৪১ পেরিয়ে ২১০০ সাল পর্যন্ত যেই দল স্বপ্ন দেখতে পারে, দেখাতে পারে-মেধাবী তারুণ্য তাকেই বেছে নেবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্নের প্রতি তাদের কাছে সেই আনুগত্যই আশা করি। আশা করি, তরুণদের সমর্থন থাকবে উন্নয়নের প্রতি, অসাম্প্রদায়িক সমাজের প্রতি, বাঙালি পরিচয়ের প্রতি, প্রগতিশীলতার প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি আগামী নির্বাচনে এবং চিরকাল।
বঙ্গবন্ধুপ্রেমী একজন শহীদ সন্তান হিসেবে আমার নিজের একটি ক্ষুদ্র চাওয়া আছে সবার কাছে। আগামী ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হবে। আমি চাই সেটা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হোক। সেটা একমাত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই সম্ভব। আমি চাই সকল তরুণের ভোটে, আমাদের সকলের ভোটে এই সরকার আবার ক্ষমতায় আসুক এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হোক বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত দিয়ে। সেই উৎসবে আমি কোটি জনতার সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে দেব সেই শ্লোগান, যে স্লোগান ছিল সব শহীদের উচ্চারিত শেষ জয়ধ্বনি- প্রাণ খুলে চিৎকার করে বলব ‘জয় বাংলা’।
লেখক : শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি
এসএইচ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।