তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদের দৃষ্টিতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব
প্রকাশিত : ১০:০৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
শারমিন আহমদ লেখক ও গবেষক। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা। তার মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই বিপ্লব নিয়ে তিনি বলেছেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এবং মানুষের যখন আর হারাবার ভয় থাকে না তখন মানুষ মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করে যায়, সে অবস্থাই ঘটেছে জুলাই বিপ্লবে। শতাব্দীতে একবার কিংবা দু’বার এরকম সময় আসে। আমাদের জীবনে এটা একবার এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, আবার এসেছে এই গণ-অভ্যুত্থানের সময়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শারমিন আহমদ বলেছেন, ‘৩৬ জুলাইকে জনঅভ্যুত্থান আবার জনবিপ্লবও মনে করছি। দুটোরই সমন্বয় ঘটেছে। ছাত্র-জনতার জনঅভ্যুত্থান বা মাস আপরাইজিংটা হয়েছে একটা নির্মম স্বৈরাচারী সিস্টেমের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। যদি জনগণকে দমন-পীড়ন করা স্বৈরাচারী বাহিনী জিতে যেত তাহলে ঐ পরিবর্তনটা অভ্যুত্থানেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এই গণ-অভ্যুত্থান, যার মধ্যে দিয়ে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে তা বিপ্লবের সূচনা ঘটায় এবং বিপ্লবের প্রথম ধাপে পৌঁছে যায়।’
তিনি বলেছেন, ‘বিপ্লবটা তখনই সফল ও সম্পূর্ণ হয় যখন অভ্যুত্থান পরবর্তী যে সরকারটা আসে সেটা জনগণের আশা আকাঙক্ষার প্রতিফলক হয় এবং রাষ্ট্র কাঠামোয় বিরাট বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যায়, সেটা কিন্তু অনেক সময় সাপেক্ষ এবং তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে সঠিক নেতৃত্বের ওপর।’
‘ইতিহাসে দেখা যায়, জনবিপ্লব সাধারণত হয় আর্মড রেভ্যুলুশনের মাধ্যমে যেখানে অস্ত্র বিদ্যায়, অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত বাহিনী থাকে এবং একটা রাজনৈতিক সেন্ট্রাল লিডারশীপ থাকে, যেমন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা রুশ বিপ্লবের সময়। কিন্তু আবার দেখা গেছে যে, বিশ্বের অনেক জায়গায় যেমন পর্তুগালে, ফিলিপিনে, তিউনিশিয়ায়, মিশরে এসব জায়গায় জনবিপ্লব হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। জনগণ অস্ত্র ধরেনি কিন্তু স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে।’
শারমিন আহমদ বলেন, ‘সেটার সাথে বাংলাদেশের ২০২৪ এর শান্তিপূর্ণ জনবিপ্লবের কিছু চরিত্র মিলে যায়। এ কারণে এটাকে আমি জনবিপ্লবও মনে করছি। ছাত্র-জনতারা নিরস্ত্রই ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র তার পুলিশ বাহিনীকে অবৈধভাবে ব্যবহার করেছে তাদেরই জনগণের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই বিপ্লবীরা প্রশিক্ষিত ছিল না এবং কোনো সেন্ট্রাল লিডারশীপও তাদের পরিচালিত করেনি। এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান। কিন্তু তারা জীবন দিতে ভয় পায়নি। তারা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। এর ফলে স্বৈরাচার ব্যবস্থার এমন পতন ঘটেছে, এটা বৈপ্লবিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৬ বছরে অনেক রাজনৈতিক দল অনেক কথা বলেছে, কিন্তু আমরা দেখিনি এ রকম কোন বিপ্লব তারা ঘটাতে পেরেছেন যা আমরা দেখলাম এই জুলাই-আগস্টে। সাধারণ জনগণ কিন্তু ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়াল। তাদের বিশ্বাস করল। তরুণদের ওপর ভরসা রাখল। এটা কিন্তু নোটিস করার মতো একটা বিষয়। এদের অধিকাংশই কিন্তু নির্দলীয়।’
‘সমার্থক এ অর্থে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়েও মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটা নির্মম জনবিরোধী, অত্যাচারী ও স্বৈর-সামরিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সরকার কায়েম করা। এটা জনযুদ্ধ এ কারণে যে, এখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, সামরিক, বেসামরিক সকলেই এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে এক লাখ এক হাজার প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু বাকি যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ তারাও তো ছিলেন যোদ্ধা। যে নারী ডাল-ভাত রান্না করে, আঁচলে সেই খাবার লুকিয়ে, খান সেনাদের চোখ এড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছেন তিনিও তো একজন জনযোদ্ধা। যে বাবা, যে মা, তার একমাত্র ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন দেশ স্বাধীন করার জন্যে তিনিও তো জনযোদ্ধা। এভাবে সারা দেশের মানুষইতো আত্মিক দিক দিয়ে কখনও খাদ্য জুগিয়ে, ওষুধ জুগিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন। এ জন্যে এটা জনযুদ্ধ।’
‘তবে ২০২৪ এর জনবিপ্লবের সাথে এর পার্থক্যটা হলো ১৯৭১ এর ওই যুদ্ধটা ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ যা জাতির জীবনে একবারই ঘটে। স্বাধীনতার যুদ্ধ হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরাধীন বা ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করা। একটি রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির জন্যে যে উপাদান দরকার জনগণ, ভূখণ্ড, সরকার, সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি এসব আমরা দেখি স্বাধীনতা যুদ্ধে। তার মানে স্বাধীনতা যুদ্ধের গর্ভ থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি। স্বাধীনতা যুদ্ধ না হলে আমরা বাংলাদেশ পেতাম না। এই যুদ্ধকে আমরা মুক্তিযুদ্ধও বলি কারণ দেশ স্বাধীন হবার পর নবজাত রাষ্ট্রে আপামর মানুষের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক মুক্তি মিলবে এই আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাসে জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।’
‘আর ২০২৪ এসে যেটা হলো সেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই আরেকটা স্বৈরাচারী শাসক যারা এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করছিলেন তার বিরুদ্ধে মানুষ লড়েছে। এ কারণে এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। আর মিল বা সাদৃশ্য হলো দুটোতেই জনগণ মনে করেছে আমরা আমাদের নাগরিক অধিকার হারাচ্ছি, ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধে জনগণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যে দাঁড়িয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো ২০২৪ এসেও সেই একই বিষয়, সেই একই আকাঙ্ক্ষা। এভাবে দুটোই সমার্থক। মিলও আছে অমিলও আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় অথবা মানুষ যখন একেবারে তলায় পড়ে যায়, তখন তার উপরে উঠতেই হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আর তো পেছাতে পারবে না, সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এবং মানুষের যখন আর হারাবার ভয় থাকে না তখন মানুষ মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করে যায়, সে অবস্থাই ঘটেছে জুলাই বিপ্লবে। শতাব্দীতে একবার কিংবা দু’বার এরকম সময় আসে। আমাদের জীবনে এটা একবার এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, আবার এসেছে এই গণ-অভ্যুত্থানের সময়। এই অদম্য স্পিরিটটা, এটা কিন্তু একটা পবিত্র স্পিরিট, যখন মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় জীবন, তাকে হারানোর ভয়টা অতিক্রম করে যায় তখনই কিন্তু ওই জাতি জেতে। এটা কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার। এই স্পিরিটটাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে।’
‘আমি এই স্পিরিটটাকে একটা অসীম সাহসিকতাপূর্ণ শক্তি হিসেবে দেখি। এটা মৃত্যুঞ্জয়ী ও সম্ভাবনার একটা স্পিরিট। জুলাই বিপ্লবের পরে শহীদদের স্মরণে ঢাকায় আমি অনেক সেমিনারে, সভায় অংশ নিয়েছি। সেখানে দেখেছি যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অনেকেই বাবা মাকে লিখে রেখে আন্দোলনে গেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, আমি চলে যাচ্ছি। আমি শহিদ হলে প্রচার কর। সবাইকে বলো যেন সবাই অনুপ্রাণিত হয়। এর মানে সে শেয়ার করছে তার আত্মত্যাগটা। এর জন্যে সে প্রাউড ফিল করছে। তার মধ্যে একটা আশা, যে কারণে সে আত্মত্যাগ করেছে সেটা বাস্তবায়ন হবে। এ কারণে এ বিপ্লবকে আমি একটা আশার স্পিরিট, সম্ভাবনার স্পিরিট হিসেবেও দেখি। এটা একটা ভীষণ পবিত্র স্পিরিট। এটা নিষ্কলুষ। কারণ সকল দ্বেষ, হিংসা সবকিছুর ঊর্ধ্বে তারা একতাবদ্ধ হয়েছিল। পুরো জাতি, জনগণ একতাবদ্ধ হয়েছিল।’
তাজউদ্দিন কন্যা বলেন, ‘মাত্র তো চার মাস হলো নতুন সরকারের। চার মাস খুব অল্প সময় বলার জন্যে। তবে কিছু কিছু ইন্ডিকেটর তো পাওয়া যায়। এখনো সার্বিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। আরও বছরখানেক গেলে বলা যাবে। তবে কি মর্নিং শোজ দ্য ডে। আমি মনে করি না এই অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটটাকে ইফেক্টিভলি প্রতিফলিত করতে পারছে। এ বিপ্লবটা সফল হতো না এত শহীদের আত্মদান ছাড়া। আমাদের ২০ হাজারেরও উপরে মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এর ফিফটি পার্সেন্ট দৃষ্টি হারিয়েছে। তাদের দৃষ্টির বিনিময়ে আমাদের নতুন দৃষ্টি দিয়েছে। একটা নতুন বাংলাদেশকে আমরা দেখতে পারছি। কিন্তু তাদের দেখভাল কি আমরা ঠিকমতো করতে পারছি? তারা হচ্ছেন আমাদের রাষ্ট্রের ভিভিআইপি। আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন দরকার। সরকার করছে, কিন্তু খুবই ধীর গতিতে। কিন্তু এখানে আমাদের খুব স্পিডে কাজ করতে হবে। জুলাই স্পিরিট নিয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়গুলোকে কাজ করতে হবে।’
‘তবে একটি বিষয় ইতিবাচক যে, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমবারের মতো ভারতের সাথে কথা বলেছে চোখে চোখ রেখে। সমতার ভিত্তিতে। এই স্পিরিটের সাথে ১৯৭১ সালের স্পিরিটের একটা মিল পাচ্ছি আমি। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার ১০ এপ্রিলের প্রথম বেতার ভাষণে এবং পরেও বারবার বলেছেন এবং কাজে প্রমাণ করেছেন ভারতসহ অন্য সকল রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক হবে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে।’
এএইচ
আরও পড়ুন