ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

তাজউদ্দীনের জীবনে তিনটি ব্যতিক্রমী ঘটনা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৫৭, ২৩ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ১৫:০৯, ২৫ জুলাই ২০১৮

১৯৭০ সাল। নভেম্বর মাস। এ সময় দেশব্যাপী ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়। ডিসেম্বরে ছিল নির্বাচন। অনেকে তাজউদ্দীন আহমেদের বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এমন সময় তার বাড়ির জানালায় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে একটা বুলবুলি পাখির মৃত্যু হয় । অন্ধকারে লুকিয়ে ক্রন্দনরত তাজউদ্দীন আহমেদকে তার মেয়ে দেখে ফেলেন। ইয়াহিয়ার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সারাদিন আন্দোলনরত আমাদের বঙ্গতাজ মেয়েকে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, "আমার বাসায় এতো মানুষের জায়গা হলো, অথচ এই ছোট্ট বুলবুলি পাখিটার জায়গা হলো না...।"

১৯৫২ সালের ২৪ মার্চ ডায়েরিতে লিখলেন ,`` আগুনে চালাঘর পুড়ে গেছে । কুপি থেকে আগুন লেগেছিল । মাচানের কিছু তক্তা রক্ষা করতে সাহায্য করি। আমি এগিয়ে যাবার আগে সবাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।``

পরে , অনেক , অনেক বড় আকারে ওই একই ঘটনা ঘটেছিল , তার সামনে। আগুন লেগেছিল তার সামনে। কিংকর্তব্যবিমুঢ হয়ে গিয়েছিল দেশবাসী । কি করবে ভেবে পায়নি। তাজউদ্দীন আহমদ দাঁড়িয়ে থাকেননি , তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন অন্তত তক্তা হলেও বাঁচে । এই খানেই অসাধারণ তিনি। দায়িত্বপ্রবণ। স্থিরবুদ্ধি। তিনি না থাকলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেহারা অন্যরকম হতো নিশ্চিত।

৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মূল কার্যালয় ছিল। সেখানেই একটা কক্ষে নয় মাস কাটিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেখানে ছিল মাত্র একটা চৌকি, কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর দিয়ে আটকানো একটা মশারি, একটি বালিশ, একটি মাদুর, একটি কাথা এবং একটি চাঁদর। আর ব্যক্তিগত জিনিস বলতে দুটো ট্রাউজার, দুটো হাওয়াই শার্ট, কয়েকটি গেঞ্জি, মোজা ইত্যাদি। মাত্র দুটো শার্ট পরেই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন রনাঙ্গন, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প, শরনার্থী শিবির; সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিদেশি সাংবাদিকদের। সাধারণের মাঝেও অসাধারণ তিনি।

১৯৭১ সালে যখন ভারতে বসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এবং দেশের শাসনকার্য নিয়ে ব্যস্ত, তখনকার ঘটনা।

তাজউদ্দীন সাহেব সকালে অফিসে এসে দেখলেন, তার পিয়ন তখনো আসেনি । তিনি থিয়েটার রোডের পিয়নের সেই বাসায় চলে গেলেন । তার অন্য এক কর্মচারী অফিসে এসে, তাকে না পেয়ে সেই পিয়নের বাসায় গেলেন । গিয়ে দেখেন, বাসায় আর কেউ নেই, শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেব জ্বরে আক্রান্ত পিয়নের মাথায় বদনা দিয়ে পানি ঢালছেন । রাজনীতি যে মানুষের জন্য, বৈষম্য দূর করার জন্য বঙ্গতাজকে যে পেরেছে এতো মানবিকতার , মানুষকে বুকে টেনে নিতে।

বুদ্ধিমানরা ইতিহাসের সঙ্গে যায় , নির্বোধ ইতিহাসকে টেনে নিয়ে যায়। তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন আমাদের সমকালীন সঙ্গীদের অন্যতম সে জন, যিনি ইতিহাসের গতিপথকে সচেতনভাবে অনুসরণ করেছেন ।

মুজিবনগর সরকারের শপথ নেওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন , `` লাশের পাহাড়ের নীচে পাকিস্তান এখন মৃত ও সমাধিস্থ ``।

তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন-কিসিঞ্জার সরকারের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার উদ্যোগ নেয়। তাজউদ্দীনের ভাষায়, ‘পাকিস্তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি…সংগ্রামের এক পর্যায়ে আমেরিকা প্রশ্ন তোলে, স্বাধীনতা চাও নাকি মুজিবকে চাও। এর উত্তরে আমি বলেছিলাম, স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই।’ সত্যিই তাজউদ্দীন সেদিন সব ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং জাতির জনকের নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিত করেছিলেন। এই সুবিশাল অর্জনে তিনি কোনো কৃতিত্ব দাবি করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো শুধু ধাত্রীর কর্তব্য পালন করেছি মাত্র।’

তাজউদ্দীন আহমদের কথা ও তার প্রতিটি কাজের মধ্যে আমরা দেখি মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষায় তীক্ষ্ণ সজাগ, দূরদর্শী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ এক আত্মপ্রচারবিমুখ ত্যাগী নেতা ও মানুষকে। নতুন প্রজন্ম তাকে ও তার মতো ইতিহাস নির্মাণকারীদের যতই চিনবে ততই উজ্জ্বল হবে ইতিহাসের আকাশ ও ভবিষ্যতের পথটি।

তাই ত মোশতাকরা জানত কাকে সরালে সব কাজ হবে। তাই করলো। হত্যার আগে তাই ত বলে গিয়েছিলেন ` মুজিব ভাই জানল না কে তার শত্রু, কে তার বন্ধু?`

আমাদের তাজ , বঙ্গতাজ আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পুরোধা , রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন কতটা বাঙালি, কতটা শুদ্ধ আর বিচক্ষণ ছিল তার চিন্তা ।

শুভ জন্মদিন হে বঙ্গতাজ , ভালোবেসে, শ্রদ্ধায় আজন্ম নত প্রতিটি বাঙালি।

লেখক: লুৎফুল কবির রনি, লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী।

আআ/এসএইচ/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি