ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

তাদের পাশে কেউ নেই

আওয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ১৬:৪৭, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | আপডেট: ২২:৩৬, ২১ জুন ২০২৩

অসহায় তাহেরা খাতুন ও সঙ্গে কয়েকটি শিশু। স্থান মালিবাগ।

অসহায় তাহেরা খাতুন ও সঙ্গে কয়েকটি শিশু। স্থান মালিবাগ।

Ekushey Television Ltd.

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ব্যস্ত সড়কের মধ্যখানে আইল্যান্ডের ওপরে প্লাস্টিকের ছাউনিতে অস্থায়ী একটি ঝুপড়ি ঘর। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। ভেতরে প্রতিবন্ধি ছেলেকে নিয়ে বসে আছেন রেহেনা বেগম।

বাড়ি ঘর নেই! এখানে কেন? জানতে চাইলে আক্ষেপ করে বললেন, ‘বাড়িতো নেই, মাথা গোঁজার একটু স্থান; সেটাও নেই। ঝড় বৃষ্টি তুফানে এ রাস্তাতেই থাকতে হয়। কোথায় যাব বলেন?’

বৃষ্টির পানির ঝাপটায় চোখের পানি ধুয়ে একাকার। রেহেনা বেগম বললেন, ‘‘স্বামীর বাড়ি রাজশাহী, নদী ভাঙনে বাড়ি ঘর বিলীন হয়ে গেলে ৭-৮ বছর আগে নতুন করে বাঁচার আশায় আমরা ঢাকা শহরে চলে আসি। কিন্তু এখানে এসে থাকার কোনো জায়গা নেই। ফলে রাস্তায় থাকা শুরু করি। কয়েক বছর বেগুনবাড়ি এলাকায় ছিলাম, এখন কারওয়ান বাজারের এখানে আছি। ’’

“আমার দু’টি মেয়ে একটি ছেলে। ছেলেটি প্রতিবন্ধী। তাকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। আমার স্বামী হায়দর আলীর শারীরে নানা রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। তেমন কাজকর্মও করতে পারে না। এই বাচ্চা নিয়েও অনেক সমস্যা, ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারি না,” চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন রেহানা বেগম।

এভাবে ঢাকা শহরে অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই করছে। কেউ নদী ভাঙনে, কেউ বন্যা জলচ্ছ্বাসে, কেউ বা ঝড় তুফানে ভিটেমাটি হারিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে এই শহরে। কারো কারো গ্রামে আয় কমে যাওয়ায় নতুনভাবে বেঁচে থাকার আশায় এসে বাসা বাঁধছে ঝুপড়ি ঘর বা রাস্তার পাশের কোনো খোপে।

বাংলাদেশ জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর এর প্রভাবে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন ও কর্মহীন হচ্ছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, ভঙ্গুর অবকাঠামো, দারিদ্র্য, সংকটাপন্ন কৃষি এবং জলাবদ্ধতা ও মাটির লবণাক্ততা প্রভৃতি কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনে দেশের কৃষি, অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন সংকটের কারণেও বাড়ছে শহরমুখি স্রোত। তবে এসব মানুষদের মধ্যে অনেকেই রিকশা চালিয়ে বা পোশাক কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বেশিরভাগই থাকে কর্মহীন ও ভাসমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, “ঢাকা শহরে স্থায়ী, অস্থায়ী ও ভাসমান এই তিন ক্যাটাগরির প্রায় ২ কোটি লোক বাস করছে। এর মধ্যে ৩৬ থেকে ৪০ ভাগ মানুষ ভাসমান। এই ভাসমান লোকদের জন্য আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। কেউ তাদের নিয়ে ভাবছেও না।”

ঢাকার বাংলামোটর এলাকায় রাস্তার পাশে থাকেন জাহানারা বেগম। কুড়িগ্রামে বন্যায় বাড়িঘর সব তলিয়ে গিয়ে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়ায় তিন বছর আগে ঠাঁই নিয়েছেন ঢাকা শহরে। দুটি ছোট সন্তান নিয়ে একাই লড়াই করছেন জাহানারা। স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে ছেড়ে যাওয়ায় দু’সন্তান নিয়ে এখন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। 

ভেজা চোখে সালেহা বেগম বলেন, “নিজেদের সহায় সম্পত্তি সবই হারিয়ে ফেলেছি। এখন আর কিছুই নেই। দুটি ছেলে মেয়ে নিয়ে রাস্তার পাশেই পড়ে থাকি। স্বামী ছেড়ে গেছে। এটা আমার ভাগ্য। আমিতো বাচ্চাদের ফেলে দিতে পারি না।”

প্রতিনিয়তই এমন অনেক মানুষ বাস্তুহারা হচেছ। কিন্তু তাদের জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। সবহারা এসব মানুষদের জন্য কেউই নেই। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, উপকূল এলাকায় এমন ঝুঁকিতে রয়েছে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ। ইতিমধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তু ৬০ লাখ মানুষ রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা যায়।

অসহায় সালেহা বেগম ও আমেনা বেগম।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৭০০ মানুষ ঢাকা শহরে প্রবেশ করছে। বছরে ৬ লাখ ১২ হাজার নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে এই নগরে। সরকার ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে নানা উদ্যোগ নিলেও অতিরিক্ত মানুষের চাপে নগরজুড়ে যানজট, বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমস্যা বেড়েই চলছে।

অধ্যাপক মঈনুল বলেন, “ভাসমান এইসব মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট এলাকায় আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এদের পূর্নবাসনে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিতে হবে। তাদরেকে টার্গেট করে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিলে ভাসমান মানুষের সংখ্যা কমে যাবে। এদের থাকার বা আবাসনের সুযোগ করে দিতে সিটি করপোরেশনকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।”

একসময় এসব মানুষের অনেকের বাড়ি ঘর থাকলেও এখন কিছুই নেই। ছোট্ট একটি ব্যাগ নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে রাস্তা ঘাট বা কোনো ভবনের কোনায়। 

সরেজমিনে দেখা যায়, গুলিস্তান, রেল স্টেশন, ফার্মগেট, রাজউক, ওসমানী উদ্যান, স্টেডিয়াম, কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও, কমলাপুর, টিএসসি, এয়ারপোর্ট, যাত্রাবাড়ি, সদরঘাটসহ এসব এলাকায় রাতের বেলা ব্রিজের নিচে, প্রধান সড়কের আইল্যান্ডের ওপর, ভ্যান গাড়িতে, রেললাইনের পাশে নয়ত বিভিন্ন অফিসের নিচে যেখানেই সুযোগ পায় ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর হলেই আবার এদিক সেদিক চলে যায়।

এসব ভাসমান মানুষেরা মাঝে মাঝে পুলিশেরও হয়রানির শিকার হয়। আবার রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা তাদের এই ছোট্ট কুটির সিটি করপোরেশনের বুলডোজার গুঁড়িয়ে দিলে নিজেদের সহায় সম্বল নিয়ে পালানোরও পথ খুঁজে পায় না। 

নানা প্রান্তের মানুষ যেমন ঢাকায় আসছে তেমনি প্রতিবছর জন্ম হচ্ছে হাজার হাজার ভাসমান শিশুর। এসব শিশুর শিক্ষা-স্বাস্থ্যর নেই কোনো ব্যবস্থা। রাস্তায় জন্ম হচ্ছে, রাস্তাতেই বড় হচ্ছে। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে অনেকেই হয়ে ওঠছে সন্ত্রাসী। আবার খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেকের প্রাণ।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ড্যান্ডি নামের সহজলভ্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে ভাসমান শিশুরা। এটি এক ধরণের আঠা, যা সলিউশন নামেও পরিচিত। এটি সেবনে ক্ষুধা ও ব্যথা লাগে না। দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্ক, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া কেউ গাঁজা বা পলিথিনে গাম নিয়ে নেশা করছে। 

খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে দেখা হয় এমন ৬টি ছেলের সঙ্গে। যারা রাত ১১টার দিকে দল বেঁধে নেশা করছে। তাদেরই একজন মোহাম্মাদ শাহজালাল। বয়স ৮ কিংবা ৯ বছর হবে। বাড়ি ময়মনসিংহে। মা-বাবা আলাদা হয়ে গেলে মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। বাবাও আবার বিয়ে করে। ফলে সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শাহজালাল জানায়, তার এখন কেউ নেই। কেউ তার খোঁজও নেয় না। রাস্তায় থাকে, রাস্তাতেই ঘুমায়। পেলে খায়; না পেলে উপোস থাকে। আর সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।

হাতে পলিথিন দেখিয়ে বলে, “এই যে এগুলি খাই।”

নয়ন নামের আরেক কিশোর, যাকে অনেকে মনি বলে ডাকে। সে জানায়, তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে আসে। পরিবারের কেউই তার খোঁজ খবর রাখে না। ফুটপাতেই থাকে। কখনো কখনো চুরি করার চেষ্টা করে। পুলিশে ধরলে দুই বাড়ি দিয়ে আবার ছেড়ে দেয়।

৭টি পথশিশু। রাস্তাতেই যাদের দিন কাটে।রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় দেখা হয় ছোট্ট শিশু ফারজানা আক্তার আসমার সঙ্গে। ৮ বছর বয়সের এই শিশুটির এক পা নেই। রাস্তার পাশে ঝুপড়ি ঘরেই সে থাকে। তার সঙ্গে কথা বলতেই পঞ্চাশোর্ধ এক নারী এগিয়ে এলেন। তিনি জানালেন, মেয়েটি হতভাগা। জন্ম থেকেই এক পা হারা, আর তার মা শিশু বয়সেই মারা যায়। তারপর তারা বাবা বিয়ে করে ফেলে চলে যায়।

ক্রাচে ভর দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আসমা বলে, “আমি পড়া লেখা করতে চাই, কিন্তু কিভাবে করব। ঠিক মতো খাওনও পাই না। পা নাই, কাজও করতে পারি না। ওই যে রংপুর সেখানে ছিলাম। পরে উপায় না পেয়ে নানীর সঙ্গে ঢাকায় আসি। বাবা খোঁজ খবর নেয় না। নানী বাসায় বুয়ার কাজ করে। এতে আমাদের হয় না।”

এসব পথশিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ নানা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। রাস্তা-ঘাট, খোলা আকাশ, ফুটপাত, পার্ক, রেল স্টেশন, ফেরিঘাট, লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা বাস স্টেশনই এদের থাকার জায়গা। সারা দিন অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরে, দিনের পর দিন নেই গোসল, ময়লা আবর্জনায় ডুবে থেকেই দিন পার করে।

এ বিষয়ে কথা বলেন পথশিশুদের নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠান স্ক্যান বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মুকুল।

তিনি বলেন, ‘‘জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, যেসব শিশুর জন্য রাস্তা বসবাসের স্থান অথবা জীবিকার উপায় হয়ে আছে তাদের পথশিশু বলা হয়। সে হিসেবে ঢাকা শহরে সাড়ে ৪ লাখের মতো পথশিশু রয়েছে। ২০০২-২০০৩ সালের দিকে ছিল আড়াই লাখের মতো। প্রতিনিয়তই এসব শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। এদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য কোনো কিছুরই ভালো ব্যবস্থা নেই। এদের মধ্যে ৮৫ ভাগ শিশু মাদকে আসক্ত হয়ে আছে।

‘‘উপকূলে যেভাবে ডিজাস্টার হচ্ছে, যার কারণে মানুষ ঢাকায় এসে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে ঢাকার এবং বাইরে থেকে আগমন দুটো মিলিয়ে দ্রুত বাড়ছে। রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় গেলে দেখা যায় সেখানে বেশিরভাগ মানুষই ঘর বাড়ি হারিয়ে উপকূল থেকে এসেছে।’’ 

এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে মুকুল বলেন, “এসব শিশুকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। আমাদের দেশে শিশুদের জন্য আলাদা কোনো অধিদপ্তর নেই। তবে ১৫টি সরকারি সংস্থা এদের জন্য কাজ করে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা হলো এসব সংস্থার একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো সমন্বয় নেই। যে কারণে চাইলেও ভালো কিছু করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমরা শিশু অধিকার রক্ষায় ‘ক্রস সেক্টর বডি’ গঠন করার চেষ্টা করছি। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে সিভিল সোসাইটিসহ একটি কমিটি করে কাজ করলে দ্রুত এসব শিশুদের পুর্নবাসন সম্ভব।”

শুধু শিশু নয় এই শহরে বিশাল একটা সংখ্যার ভাসমান বয়স্ক মানুষও আছে, যাদের কেউ নেই। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হয় স্বামী মারা গেছে, না হয় সন্তান বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, অনেকে আছে যারা একেবারেই নিঃস্ব। ফলে তারা ঠাঁই নিয়েছে ফুটপাতে। বাড়ি নেই, ঘর নেই, সন্তান থেকেও নেই এমন একজন হলেন সালেহা বেগম। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার অবলম্বন ছিল একটি সন্তান। সেও মারা যায়। ফলে একবোরে একা হয়ে যান সালেহা।

“থাকতাম জামালপুরের সরিষাবাড়ি। সেখানে থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে ঢাকায় আসি। গ্রামে জায়গা-জমি কিছুই নেই। প্রথমে এসে কমলাপুর রাস্তার পাশে থাকতাম। এখন খিলগাঁও রেল লাইনের পাশে থাকি। বিশ বছর আগে স্বামী মারা যায়। একটি ছেলে ছিল পরে সেও মারা যায়। ফলে একা হয়ে যাই। কত কষ্টের জীবন বাবা তা কি বলে শেষ করতে পারব? এখন ভালোভাবে চোখেও দেখি না। অসুস্থ হলে বিছানায় পড়ে থাকি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এই জীবন শেষ হয়েছে। আয় করার মতো অবস্থা এখন আমার নেই,” বলছিলেন তিনি।

তার সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে আসেন আমেনা বেগম নামের আর একজন বৃদ্ধা। তার ছয়টি ছেলেমেয়ে, কিন্তু তাকে থাকতে হয় রাস্তার পাশে পলিথিনের ঘরে। আক্ষেপ করে বলেন, “কোনো সন্তানই আমাকে দেখে না। এখানেই আমি পড়ে থাকি।”

মালিবাগে রাস্তার পাশে ফুটপাতে থাকেন সত্তোরোর্ধ্ব তাহেরা খাতুন। স্বামীর হাত ধরে ময়মনসিংহ থেকে দুই যুগ আগে এই শহরে এসেছিলেন। কিন্তু এখন স্বামী নেই। প্রায় ১৫ বছর আগে মারা যান। অসহায় সালেহার একটি সন্তান ছিল। কিন্তু সেই সন্তানটিও ছোট সময়ে হারিয়ে যায়। 

তাহেরা বলেন, “এখন আল্লাহ ছাড়া আমার আর কেউ নেই। ভালোই চলছিল আমাদের। আমার স্বামী জাবেদ আলি একটা এক্সিডেন্ট করে। এরপর সে ঘরে বসে যায়। আর কোনো কাজ করতে পারে না। পরে মারাই যায়। আমারতো আর যাবার জায়গা নেই। পরে ফুটপাতে আশ্রয় নিতে হয়। বাসাবাড়িতে কাজ করে কোনোভাবে চলতাম। এর মাঝে আমার ছেলেটাও হারিয়ে যায়। পাগল হয়ে খুঁজি, পাই নাই। শোকে আর বিয়ে করিনি। এখন ভালোভাবে হাঁটতেও পারি না। শরীরে শক্তি নেই। কেউ কিছু দিলে খাই। না হয় পড়ে থাকি।”

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম বলেন, ঢাকার জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল নগরিতে পরিণত হবে। তখন জনসংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখ অতিক্রম করতে পারে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর শহরে বস্তির সংখ্যা ও বস্তিবাসী বেড়েই চলেছে। গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে মানুষ। এখানে অতিদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি, প্রায় ৬০ ভাগ। 

“আমাদের জাতীয় নগরায়ণে কোনো নীতিমালা নেই। মাইগ্রেশন পলিসি নেই। নগর স্বাস্থ্যসেবায় সমন্বিত সেবা কার্যক্রম নেই, যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপও নেই। ফলে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। বাস্তুহারা মানুষ বাড়ছে। এসব মানুষের পাশে সবার আগে সরকারকেই দাঁড়াতে হবে। ভিটেমাটিহীন এসব মানুষের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কর্মের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাহলেই এসব মানুষও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারবে।”

সমাজসেবা অধিদপ্তরের সিএসপিবি প্রজেক্টের সহকারি পরিচালক ইমরান খান বলেন, পথশিশুদের জন্য আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। আমাদের কাছে সঠিক জরিপ নেই। তবে সারা দেশে প্রায় ১১ লক্ষ পথশিশু রয়েছে এবং ঢাকা শহরে প্রায় ৬ লক্ষ শিশু অবস্থান করছে। আমরা এসব শিশুদের জন্য ঢাকায় ৩টি শিশু সুরক্ষা সার্ভিসেস হাবের (কমলাপুর, সদরঘাট ও গাবতলী) মাধ্যমে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। শিশুদের তিনবেলা খাবার, লাইফ স্কিলবেজ এডুকেশন, নন-ফরমাল এডুকেশন, কেস ম্যানেজমেন্ট, কাউন্সিলিং, সচেতনতামূলক পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে তাদের সেবা দেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকার বয়স্ক মহিলাদের (সর্বনিম্ন ৬২ বছর) সুরক্ষা ও স্বচ্ছলভাবে জীবন যাপনের জন্য মাসিক ৫০০ টাকা হারে বয়স্ক ভাতা প্রদান করছে। ভাসমান মানুষ এবং বয়স্ক মানুষদের উন্নয়নে সরকারের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এএইচএস
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি