ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

তারের শহর ঢাকা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:০৯, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৫৮, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

রাজধানী ঢাকার বহুদিনের সমস্যা ঝুলন্ত তার। তারগুলোকে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়ার পরও তা এখনও মাটির উপরেই আছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র। বিশেষ করে মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, বনানী, মহাখালী, গুলশানের মতো বাণিজ্যিক এলাকায় ঝুলে থাকা তার অনেক বেশি। এছাড়া ধানমণ্ডি, মিরপুর, ফার্মগেট, শাহবাগ এবং পুরান ঢাকার অনেক এলাকাতেই কুণ্ডলী পাকানো এমন তার ঝুলে থাকতে দেখা যায়।

প্রধান সড়কে প্রায়ই বিদ্যুৎ বিভাগের অভিযানের কারণে এসব ঝুলন্ত তার অলিগলিতে ছড়িয়ে গেছে। এসব তারে সড়কের দামি বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং সড়ক বাতির খুঁটির ক্ষতি হচ্ছে। তবে শুধু ঝুলে থাকাতেই সমস্যার শেষ নয়। ঝুলতে ঝুলতে অনেক স্থানে তারগুলো মাটি স্পর্শ করে ফেলছে। এ কারণে অনেক পথচারী ফুটপাত দিয়ে হাঁটেন না।

ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিশা আহমেদ ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে এসে আর ফুটপাত দিয়ে হাঁটেন না। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘এখানে বেশ কিছু জায়গায় তার ঝুলে আছে। ইতোমধ্যেই পায়ের সঙ্গে তার জড়িয়ে গিয়ে দুইবার আহত হয়েছি।’

এসব তার যে শুধু দৃষ্টিকটু আর নগরীর সৌন্দর্য্য নষ্ট করে, তা নয়। এগুলো থেকে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণহানি ঘটার নজিরও আছে। তাছাড়া ঝুলে থাকা ডিশ বা ইন্টারনেটের ক্যাবল থেকে অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে যেতে পারে।

অনেক সময় দেখা যায়, পুরানো তারে ত্রুটি দেখা দিলে সেগুলো না কেটেই নতুন তার লাগিয়ে নেয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে করে তারের তৈরি জঞ্জাল দিন দিন বেড়েই চলছে।

জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকেই সরকার রাজধানীতে ঝুলে থাকা বিদ্যুৎ, ডিশ ক্যাবল, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি), মোবাইল কোম্পানি, বিটিসিএলের ল্যান্ড ফোনের তারসহ সব ধরণের তারকে বিশ্বের অনেক আধুনিক শহরের মতো মাটির নিচ দিয়ে স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) প্রকল্পের আওতায় ২টি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম এবং সামিট কমিউনিকেশনকে মাটির নিচ দিয়ে তার পরিচালনার জন্য অবকাঠামো স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, তাদের তৈরি ভূগর্ভস্থ ফাইবার অপটিক্সের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেবা দেবে সংস্থাগুলো। এতে করে পুরো দেশে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় সব প্রতিষ্ঠান মাটির নিচ দিয়েই তাদের সংযোগ প্রদান করতে পারবে। প্রকল্প মোতাবেক সরকারি সংস্থাগুলোর প্রায় বেশিরভাগ তারই মাটির নিচে চলে গেলেও বেশিরভাগ ডিশ অপারেটর আর ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের তার এখনও মাটির উপরেই রয়ে গেছে। বৈদ্যুতিক খুঁটি কিংবা সড়ক বাতির খুঁটির সঙ্গে পেঁচিয়ে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক আকার ধারণ করেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। এমনকি নিকুঞ্জ, মহাখালী ডিওএইচএস, মতিঝিল, কারওয়ান বাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় প্রায় প্রতিটি ভবনে তার সংযোগের জন্য এফটিটিবি/এইচ জোন তৈরি করেছে তারা। শুধু ফাইবার অ্যাট হোমই ঢাকা শহরে প্রায় ১৭শ কিলোমিটারজুড়ে স্থাপন করেছে এ ফাইবার নেটওয়ার্ক। প্রায় ৬০০টিরও বেশি লোকাল ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট (ভূগর্ভস্থ তারের সঙ্গে সংযোগস্থল) বসানো হয়েছে। এছাড়াও প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট রয়েছে। তবুও প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না ক্যাবল অপারেটর এবং আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।

এর কারণ অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে নেপথ্যের ঘটনা। এনটিটিএনের সঙ্গে যুক্ত হতে এর লাইসেন্সধারী অপারেটরগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হয়, যা দিতে নারাজ ক্যাবল অপারেটর এবং আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়াও আইএসপি না হয়েও কিছু অবৈধ আইএসপি নামধারী প্রতিষ্ঠান তাদের এলাকাভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য যুক্ত হতে চায় না এনটিটিএন-এর সঙ্গে। অন্যদিকে সহজে শনাক্ত হওয়ার ভয়ে ইন্টার সেবার লাইসেন্স নিয়ে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরাও এ নেটওয়ার্কের আওতায় আসতে চায় না। অনেকে আবার এনটিটিএন-এর ব্যাপকতা এবং ব্যবসায়িক সুফল সম্পর্কে সন্দিহান। বিদ্যুৎ বিভাগ এদের তার কেটে দিলেও খানিক পরেই তারা নতুন লাইন টেনে নেয়। আর বিদ্যুৎ বিভাগের নজর ফাঁকি দিতে এখন তারা প্রধান সড়ক এড়িয়ে অলিগলি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার। সবমিলিয়ে মহানগরী ঢাকাকে এসব অবৈধ তারের বোঝা এখনও বহন করতে হচ্ছে।

তবে এনটিটিএন অপারেটরদের বিরুদ্ধেও সংশ্লিষ্টদের বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। আইএসপি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এমএ হালিম বলেন, ঝুলন্ত তারগুলো এখনও অপসারণ করা যাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ এনটিটিএন অপারেটরদের প্রযুক্তিগত ভুল। এছাড়া মাত্র দুটি এনটিটিএন অপারেটর থেকে সার্ভিস পাওয়া যায় বলে তাদের কাছে অনেকটাই জিম্মি আমরা। তাদের নির্ধারিত দামেই সেবা নিতে হয়, যা আমাদের অনেকের জন্যই ব্যয়বহুল এবং ব্যবসাবান্ধব নয়। তাছাড়া তারা এখনও গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারেনি। যে কারণে আমরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছি না। যেখানে তাদের সংযোগ আছে আমরা সেখানে ঠিকই তাদের সঙ্গে যুক্ত হই।

ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) নেতা ও ক্যাবল অপারেটর ব্যবসায়ী সৈয়দ হাবীব আলী ইটিভি অনলাইনকে বলেন, আমরাও চাই এনটিটিএনের সঙ্গে যুক্ত হতে। কিন্তু ঢাকার সব এলাকায় তাদের এখনও সংযোগ স্থাপন শেষ হয়নি।

এনটিটিএন অপারেটর ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান জনসংযোগ ও গভর্নমেন্ট রিলেশন এবং রেগুলেটরি এফেয়ার্স কর্মকর্তা আব্বাস ফারুক বলেন, আমরা নগরীতে ১ হাজার ৭০০ কিমি. ম্যাস নেটওয়ার্ক করেছি এবং বেশকিছু এলাকায় বিল্ডিং টু বিল্ডিং সলিউশন করেছি। এখনই প্রধান সড়ক এবং এসব এলাকার সব তার মাটির নিচে নেওয়া সম্ভব। শুধু দরকার সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও সদিচ্ছা। আমরা যৌক্তিক মূল্যেই এ আধুনিক সেবা দিচ্ছি।

ডিশ অপারেটর এবং আইএসপিদের কাছে এক ধরণের জিম্মি সরকারি এ সংস্থাগুলো। এ কমিটির আহ্বায়ক বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব বজলুর রহমান জানান, আমরা প্রায়ই অবৈধ তারের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই। মাথার ওপর ঝুলে থাকা তার অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে চাপ প্রয়োগ করি। কিন্তু এ তার ফুটপাতের অবৈধ দখলদারদের মতো হয়ে গেছে। একবার অভিযান করে এলে কিছুক্ষণ পরেই আবার তার ঝুলতে দেখা যায়।

বিটিআরসি’র মিডিয়া উইংয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মো. জাকির হোসাইন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, গত মার্চেও আমরা আইএসপি এবং এনটিটিএন অপারেটরদের নিয়ে একটি সভা করি। সেখানে এনটিটিএন অপারেটরদের আইএসপিদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে বলি।

 

ডিডি/এসএইচএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি