ঢাকা, শনিবার   ৩০ নভেম্বর ২০২৪

তিতাসের মৃত্যু, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:২৮, ৩০ জুলাই ২০১৯ | আপডেট: ২২:৩১, ৩০ জুলাই ২০১৯

ভিআইপি যাতয়াতের জন্য গণপরিবহণে সাধারণ মানুষের হয়রানির ঘটনা নতুন নয়। একজন ভিআইপি আসাকে কেন্দ্র করে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে দীর্ঘসময় ফেরি আটকে রাখার কারণে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা স্কুল ছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তীব্র সমালোচনা চলছে।

বুধবার বিকেলে নড়াইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় স্কুল শিক্ষার্থী তিতাস ঘোষ। প্রথমে তাকে ভর্তি করা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। তিতাসকে নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে এম্বুলেন্সে করে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে পৌঁছান স্বজনেরা। কিন্তু ফেরির জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয় কয়েকঘন্টা।


এসময় ঘাটে থাকা ফেরিটি একজন যুগ্মসচিবের আসার অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘন্টা বিলম্বের পর যাত্রা করে। মাঝ নদীতেই তিতাসের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনেরা। তিতাসের বাড়িতে এখন শোকের মাতম। এম্বুলেন্সে আশঙ্কাজনক অবস্থায় একজন রোগী থাকার কথা ঘাট কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বারবার জানিয়েও ফেরিটি চালু করা যায়নি বলে অভিযোগ তিতাসের স্বজনদের।


স্কুলছাত্র তিতাসের মৃত্যুর খবরে ক্ষুদ্ধ্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষের করের টাকায় বেতন পাওয়া সরকারি কর্মচারীদের নিজেদের ভিআইপি মনে করার বিষয়টি নিয়ে - যে প্রবণতা বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এর আগেও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।


তানবীর সিদ্দিকী তার নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ফেরীতে কিশোর তিতাস এর মর্মান্তিক মৃত্যু আর ভিআইপি সংস্কৃতি আমাকে একটি বিষয় নতুন করে ভাবতে সাহায্য করেছে। দেশের মালিক জনগণ সংবিধানের স্পষ্ট লেখা থাকা সত্ত্বেও আমাকে হয়রানির শিকার হতে হয়। যেদিন এদেশের জনগণ বুঝবে প্রজাতন্ত্রের মালিক তারা সেদিন এদেশে সুশাশন আসবে। সরকারের জন্য সহজ হবে দেশ পরিচালনা করা। সমৃদ্ধ হবে দেশ।


তপু মোজুমদার তপু লিখেছেন, তিতাসের মা বোন আবার দৌড়ালেন দৌড়াতে দৌড়াতে পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে পুলিশের দুপায়ে মাথা ঠেকিয়ে মা মেয়ে কাঁদতে থাকেন। পুলিশ বললেন আপনারা ফেরিতে যান ভিআইপি ভাঙ্গা পর্যন্ত চলে আসছে। এই ভাবে ঐ খানের সমস্ত কর্মকর্তাদের পা ধরে ধরে মা মেয়ে সন্তান ও ভাইয়ের জন্য অবিরাম কাঁদতে থাকেন। অথচ এই রাষ্ট্র যন্ত্র তখনও নিশ্চুপ ভিআইপি মন রক্ষায়। এই করতে করতে রাত ১২ টা বাজলে ভিআইপি ঘাটে আসেন এবং ফেরি ছাড়েন। ততক্ষণে যা হবার তাই হয়ে গেলো।


তিতাসের বোন বৃষ্টি অনবরত কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন আমার একটা মাত্র ভাই প্লিজ আপনারা একটু ওকে বাঁচাতে সাহায্য করুন। এই ভাবেই তিতাসের মৃত্যু মাঝনদীতে যখন হয় তখন চারিদিকে অন্ধকার আর থৈ থৈ স্রোতের শব্দ! স্রোতের শব্দের সাথে তিতাসের মা বোনের কান্নার আওয়াজ প্রমত্ততা পদ্মার হৃদয় কে ও নাড়িয়ে দিলেন! কিন্তু পাষাণ হৃদয় একবারও কাঁপলো না।৩০ লক্ষ শহীদের জীবন বলিদান কি এমন রাষ্ট্র সেবার জন্য-? ক্ষমা করে দিয়েন আমাদের তিতাসের দুখিনী মা! তিতাসের বোন! এই রাষ্ট্র শুধু ভিআইপিদের জন্য!


তাসলিম পেরু আক্ষেপ প্রকাশ করে লিখেছেন , ভিআইপি! তিতাস কিন্তু মারা গেলো--! জনগণের ট্যাক্সে এই রাষ্ট্রে যারা ভি.আই.পি. গিরি করে। সকল রকমের সুযোগ সুবিধা শুধু তাদের জন্য। ৩০ লক্ষ শহীদের জীবন বলিদান কি এমন রাষ্ট্র সেবার জন্য -? মাফ করে দিয়েন তিতাসের মা! তিতাসের বোন! সবচেয়ে দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, সেই ভি.আই.পি.'র নির্দেশেই গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। আমার কাছে যদি কোন সুপার পাওয়ার থাকতো তাহলে আইন নিজের হাতেই তুলে নিতাম।
মিথুন মাহমুদ তার ফেইসবুকে লিখেছেন, গুলি করে মানুষ হত্যা করা, আর ফেরী আটকে রেখে রোগী মারা একই।


নির্ধারিত সময়ে ফেরি না ছাড়ায় অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।


তিতাস ঘোষের মামা রাজীব ঘোষ  যিনি তিতাসের মা, বোনসহ সেদিন ঐ অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন - বলেন, তারা বহুবার অনুরোধ করলেও সেসময় ঘাটে উপস্থিত নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বরত কমকর্তা বা পুলিশ সদস্যরা ভিআইপি ফেরি চলাচল শুরু করতে রাজি হননি।


তিনি বলেন, "আমরা সাড়ে আটটার কিছু আগে কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে পৌছানোর প্রায় আধঘন্টা পর যখন দেখি যে ফেরি চলাচল হচ্ছে না, তখন সেখানে উপস্থিত লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারি যে ভিআইপি আসবে বলে ফেরি ছাড়া হচ্ছে না।"


রাজীব ঘোষ জানান, শুরুতে তারা সেখানে উপস্থিত কর্মচারীদের অনুরোধ করেন, তারা ফেরি ছাড়তে অপারগতা প্রকাশ করলে ঘাটের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে এবিষয়ে কথা বলেন।


এর মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে পুলিশের হটলাইন নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে এ বিষয়ে জানালেও কোনো ধরনের সাহায্য পায়নি বলে জানান তারা। শুরুতে সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাদের কথা 'গ্রাহ্যই করেনি' বলে অভিযোগ করেন রাজীব ঘোষ।


"মুমূর্ষু রোগী আছে বলে ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যদের কাছে আমরা অনুরোধ করি ফেরি ছাড়তে, কিন্তু তারা আমাদের কথা গ্রাহ্যই করেনি।" একপর্যায়ে তিতাসের মা এবং বোন পুলিশ সদস্যদের পায়ে ধরে অনুনয় করলেও কোনো কাজ হয়নি ।


এরপর সাড়ে দশটার দিকে একজন পুলিশ সদস্য এবং ঘাটের দায়িত্বে নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা ফেরিতে অ্যাম্বুলেন্স সহ অন্যান্য গাড়ি উঠানোর অনুমতি দেন। যেই ভিআইপি'র গাড়িটির জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল, সেটিও সেসময় ফেরিতে ওঠে। রাজীব ঘোষ জানান, ফেরি চলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই তিতাস মারা যায়।


এই ব্যাপারে জানতে চাইলে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেন - যিনি বৃহস্পতিবার রাতে ঘাটে উপস্থিত ছিলেন না -  জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর তিনি ঘাটের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ফিরোজ আলমের কাছ থেকে জানতে পারেন যে অ্যাম্বুলেন্সে মুমূর্ষু রোগী ফেরির অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি তখনই ভিআইপি'র সাথে যোগাযোগ করে ফেরিতে গাড়ি উঠানোর নির্দেশ দেন বলে জানান।


সালাম হোসেন বলেন, "রাত ১০টার পর উচ্চমান সহকারী ফিরোজ আলম, যিনি আমার অনুপস্থিতিতে ঘাটের দায়িত্বে ছিলেন, আমাকে ফোন করে জানায় যে অ্যাম্বুলেন্স ফেরির অপেক্ষায় আছে। আমি তখনই ভিআইপি'কে ফোন করে তার অবস্থান জেনে নিয়ে ফেরিতে গাড়ি ওঠানোর নির্দেশ দেই।"


এরআগে সকালে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক সালাম হোসেনকে একজন ভিআইপি'কে ফেরি পারাপারের বিষয়ে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করেন। উচ্চমান সহকারী ফিরোজ আলমও দাবি করেন, রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনি প্রথম জানতে পারেন যে ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে মুমূর্ষু রোগী রয়েছে।


"আমি যখনই জানতে পারি যে রোগী অপেক্ষা করছে ফেরির জন্য, তখনই ব্যবস্থাপক সালাম হোসেনকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে ফোন করে বলেন ফেরিতে গাড়ি ওঠাতে।"


একইরকম বক্তব্য দেন ফেরিঘাটের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ট্রাফিক সাব ইন্সপেক্টর গাজী নজরুল ইসলাম। তিনি নজরুল ইসলাম বলেন, "রাত দশটা থেকে আমার ডিউটি শুরু হয়। সোয়া দশটার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা মুমূর্ষু রোগীর দুই আত্মীয় আমাকে ঘটনা বলার সাথে সাথেই আমি দায়িত্বে থাকা ফিরোজ আলমকে এবিষয়ে অবহিত করি। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরিতে গাড়ি ওঠানো হয় এবং ফেরি ছেড়ে দেয়।" তবে তিনি ডিউটিতে আসার আগে পুলিশের কাছে এই ঘটনা জানানো হয়েছিল কিনা, সেবিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি নজরুল ইসলাম।


নজরুল ইসলামের আগে ঘাটের পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার ফোন বন্ধ থাকায় এবিষয়ে তার সাথে কথা বলা যায়নি। আর ঘাটের দায়িত্বে থাকা পুলিশের কাছে ভিআইপি চলাচলের কোনো বার্তা ছিল না বলেও নিশ্চিত করেন নজরুল ইসলাম।
টিআর/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি