ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

তিন বছরেও আলোর মুখ দেখেনি পর্যটন উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:০৪, ২০ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ০৯:৩৭, ২৭ আগস্ট ২০১৮

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের একটি দেশ। আয়তনে ছোট হলেও আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আর আছে অপার সৌন্দর্য। এদেশের সৌন্দর্যে যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা মুগ্ধ হয়েছেন। তবে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ ও পরিকল্পনার অভাবে পর্যটন খানে উন্নয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে ২০১৫ সালে জাতীয় পর্যটন পরিষদের উদ্যোগে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু হলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে দেশের পর্যটন খাত। দেশের প্রধান পর্যটন স্থানগুলোতে সমন্বিত পরিকল্পনার ছাড়াই গড়ে উঠছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো। এতে দিনে দিনে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। হারাতে বসেছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনস।

এছাড়া দেশের একমাত্র সন্দুরবনে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখান সৃষ্টি্ উদ্যোগে নষ্ট হচ্ছে সুন্দরবনের পরিবেশ। কুয়াকাটাসহ অন্যান্য গন্তব্যগুলোয় নেই পর্যটক আকর্ষণের উপযোগী পরিবেশ। ফলে অনেক সম্ভবনা থাকার পরেও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দেশের পর্যটন খাতকে বাচঁতে দরকার মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে জাতীয় পর্যটন পরিষদের সিদ্ধান্তের আলোকে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করে বিটিবি। তবে সে কাজের এখনও দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।

মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে কনসাল্টিং ফার্ম নিয়োগের জন্য সম্প্রতি আগ্রহ ব্যক্তকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বিটিবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশি-বিদেশি ১২টি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক আবেদন করেছে। বিটিবি তা মূল্যায়নের মাধ্যমে আগ্রহী কম্পানিগুলোর মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ সাতটি এবং সর্বনিম্ন চারটি কম্পানির সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে টার্মস অফ রেফারেন্সের আলোকে ৪২ দিনের মধ্যে কারিগরি এবং আর্থিক প্রস্তাব আহ্বান করবে। তাদের প্রস্তাব পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাইয়ের পর একটি প্রতিষ্ঠানকে কনসাল্টিং ফার্ম নিয়োগে চুক্তি স্বাক্ষর করবে বিটিবি।

এরপর তারা সারা দেশের পর্যটন গন্তব্যগুলো জরিপ ও সম্ভাব্যতা যাচাই করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিস্তারিত পরিকল্পনা দেবে। এমনকি তাতে স্থাপত্য পরিকল্পনাও থাকবে। এরপর জাতীয় পর্যটন পরিষদ ও মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।

এবিষয় জানতে চাইলে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, দেশে পর্যটক আকর্ষণে পরিকল্পিত পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। হঠাৎ করে দু-চারটি মিটিং হলে কোনো লাভ হবে না। ট্যুরিজমের সঙ্গে জড়িত সব বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। সবার মতমত নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা নিতে হবে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যান্য দেশে ২০ থেকে ২৫ বছর আগে থেকে পরিকল্পনা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তারা অনুযাযী বড় ধরনের প্রচার কার্যক্রম চালান। আমাদের দেশে তেমন কোন পরিকল্পনা নিতে দেখা যায় না। এছাড়া বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। বাংলাদেশের ট্যুরিজমকে উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই সব বিভাগের সমন্বয় করে কাজ করা জরুরি।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সাকের আহমেদ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, পর্যটন খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তবে তার জন্য দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন। গত বছর অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৪০ লাখ, যেখানে বিদেশি পর্যটক মাত্র চার লাখ। প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও যৌথ উদ্যোগে কাজ করলে দেশীয় পর্যটকদের এই সংখ্যা এক কোটি এবং বিদেশি পর্যটক ১০ লাখ অতিক্রম করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

এবিষয় জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব মুহিবুল হক একুশে টিভি অনলাইন বলেন, দেশের পর্যটন খান উন্নয়নে ‘মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে কনসাল্টিং ফার্ম নিয়োগের জন্য টেন্ডার আহ্বান হয়েছে ইতোমধ্যে এখন বাছাই প্রক্রিয়া চলছে। মাসখানেকের মধ্যে আমরা প্রাথমিক কাজগুলো করতে পারব। মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন হলে সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের পর্যটন খাতের বিকাশ ঘটবে বলে আশা করি।

পর্যটনের উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যানের বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপপরিচালক এ কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে যে পর্যটন স্থানগুলো রয়েছে সেগুলো যাথাযথভাবে পরিকল্পনা প্রণায়ন করা হলে সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হবে এ খাত।এলক্ষে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির জন্য এবার আমরা সময় রেখেছি ১২ মাস। আমরা আশা করছি, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের প্রথম ধাপের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হবে। বাকি কাজ পরবর্তী অর্থবছরে শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি।

বিটিবির এই কর্মকর্তা আরও জানান, মাস্টারপ্ল্যানের কনসাল্টিং ফার্ম হিসেবে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে শর্টলিস্ট চূড়ান্ত করতে আজ সোমবার একটি সভা হবে। এরপর সংক্ষিপ্ত তালিকায় নির্বাচিত কোম্পানিকে আর্থিক ও কারিগরি প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হবে।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ ও বিপণন) মো. জিয়াউল হক হাওলাদার  এ বিষয়ে বলেন, জাতিসংঘ পর্যটন সংস্থা ইউএনডাব্লিউটিওর সহায়তায় ১৯৮৮ সালে মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছিল। কক্সবাজার, কুয়াকাটা নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে মাস্টারপ্ল্যান হলেও আমাদের পর্যটন খাতের পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান আজও হয়নি। এখন একটি হালনাগাদ মাস্টারপ্ল্যান হতে পারে যেখানে প্রত্যেকটি পর্যটন গন্তব্য চিহ্নিতকরণ এবং সেগুলোকে প্রডাক্ট হিসেবে রূপান্তর করতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। ২০০৭ সালে পর্যটন করপোরেশন পুরো বাংলাদেশকে ছয়টি ভাগে ভাগ করে একটি মাস্টারপ্ল্যান করেছিল। সেটি ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী সময়ে আর বাস্তবায়ন হয়নি।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) গভর্নিং বডির সদস্য জামিউল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের পর্যটন চলছে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই। এতে না আছে ব্যবস্থাপনা না আছে কোনো শৃঙ্খলা। যে যার মত করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসে তা চাপিয়ে দিচ্ছে। কোনটা আগে হবে, কোনটা পরে হবে তা নিয়ে কোনো চিন্তাও করা হচ্ছে না। ফলে এ শিল্পের জন্য পরিকল্পনামাফিক উন্নয়নকাজ করার কোনো সুযোগ নেই। আর এ জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটির শম্বুকগতি। বছর বছর পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মহাপরিকল্পনার কিছু তো হচ্ছেই না উপরন্তু স্বল্প মেয়াদ তো বটেই এমনকি সামান্য পরিকল্পনাও অনুপস্থিত থাকছে।

তিনি বলেন, মহাপরিকল্পনার আশায় থেকে স্বল্প মেয়াদের পরিকল্পনাও থাকবে না তাও আবার পর্যটনের মতো এমন এক শিল্পের ক্ষেত্রে, যা অবিশ্বাস্য অথচ এটাই সত্য। তবে নিয়ম মানার নিয়মের মধ্যে পড়ে আটকে থাকা এই মহাপরিকল্পনার কাজটিকে গতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের গভর্নিং বডির ৩৬তম সভায় জোরালো তাগিদসহ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবার বাকিটা আবারও নিয়ম মানার গ্যাঁড়াকলে না পড়লেই হলো।

টিআর/ এআর  

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি