‘তিন’ মধ্য আগস্টের মধ্যরাত্রি
প্রকাশিত : ১৬:৩৪, ১৫ আগস্ট ২০২২ | আপডেট: ১৭:০৬, ১৫ আগস্ট ২০২২
দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক ইতিহাসে তিন সময়ের ১৫ আগস্ট সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকবে তিনটি পৃথক কারণে। প্রথমেই আসে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়। ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রে লিখে ফেলা হয় পূর্ববঙ্গের বিধি। ব্রিটিশদের সিদ্ধান্তে ভারতের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের চিরায়ত রাজনৈতিক শিকড়ের শৃঙ্খল ছিড়ে যায়। লাখো লাখো বাংলাভাষী মানুষের ভবিতব্য ঘোষণা করে দেয় ব্রিটিশ শাসকরা সেই মধ্য নিশিতে। জন্ম নেয় পাকিস্তান। পূর্ববঙ্গ চলে যায় এক অন্য সার্বভৌমত্বে। মাঝরাতের জন্ম নেওয়া এক দেশের ভৌগোলিক মানচিত্রে উদ্বাস্তু হন লাখো লাখো মানুষ। পিপিলিকা সারির মতো বাস্তুহারা অগণিত মানুষ চলে আসেন রেডক্লিফ লাইনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। কোথায় যাবেন, ঠিক কিভাবে যাবেন জানা ছিল না কারোরই।
পূর্ব-পাকিস্তান শাসন করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত এবং পাকিস্তানের শাসন ও ক্ষমতার কেন্দ্র করাচি থেকে। করাচি কখনো পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের স্বায়ত্তশাসন দেয়নি। অন্যদিকে ছিল চাপিয়ে দেওয়া উর্দুভাষা। পাকিস্তানের শাসকদের নিপীড়নে ও উপেক্ষায় বছরের পর বছর অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে বাঙালিরা। সঙ্ঘবদ্ধ হয় বাঙালি, গর্জে ওঠে স্পৃহা। ভাষার জন্য আন্দোলন করে পূর্ব পাকিস্তান। ক্ষোভের অনল থেকে স্ফুলিঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয় লড়াই। লড়াই থেকে যুদ্ধ। বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রাম রূপ নেয় সামরিক সংগ্রামে। ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠেন দেশ স্বাধীন করার। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাভাষীর আবাসস্থল ব-দ্বীপ গোটা দুনিয়ায় পরিচিত হয় বাংলাদেশ হিসেবে।
দ্বিতীয় ১৫ আগস্টের মধ্যরাত্রি- ১৯৭৫ সালের সেই ১৫ আগস্টের রাত বাংলাদেশের কাছে চিরকাল বিভীষিকার হয়ে থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের অদম্য এবং অবিসংবাদিত মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ১৮ জনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই দুহিতা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা যেহেতু বিদেশে ছিলেন তাই তারা ওই হত্যালীলা থেকে রেহাই পান। শেখ হাসিনা সেই নিশীথে বাংলাদেশে থাকলে, গোটা বাংলাদেশের ভবিতব্যই হত আলাদা, সেটা বলাই বাহুল্য। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিব, তিন পুত্র ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল এবং রোজি কামাল নিহত হন। ভাই শেখ নাসের ও মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদও (বীর উত্তম) নিষ্কৃতি পাননি। ১৬ অগাস্ট সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শমশের আলী বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যান টুঙ্গিপাড়ায়। তার পিতার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ হয়ে যায়। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ চালু হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে আবার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম ধানমণ্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন। ১৯৯৮ সালে আবদুল মাজেদসহ ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বছরের পর বছর গেলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা অন্য এক গোলার্ধে আছেন নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে। পলাতক খুনিদের দুইজন রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরীর কানাডায় আছেন তা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দুই বা অন্তত একজনকে দেশে আনা হবে। তাদেরকে ফিরিয়ে এনে যথাযথ বিচার দেশের আইন শৃঙ্খলা এবং ভাবমূর্তিকে তরান্বিত করবে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় মধ্য আগস্টের মধ্যরাত্রির কথা হলো। এবার তৃতীয় তথা সাম্প্রতিকতম মধ্য আগস্টের মধ্যরাত্রি। ১৫ আগস্ট ২০২১, ঠিক এক বছর হতে চলল। ঘটনাস্থল কাবুল। রাজধানী দখল করল তালেবান। সঙ্গে দোসর পাকিস্তানের জন্ম নেওয়া হাক্কানি নেটওয়ার্ক। প্রায় দুই দশক ধরে চলা যুদ্ধের অবসান। আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন কায়েম হল। শুরু হলো দেশজুড়ে বিভীষিকা। প্রাণপণে দেশ ত্যাগের হিড়িক। কাতারে কাতারে নিরাপত্তার খোঁজে মানুষ চলল কাতারে, ক্যালিফোর্নিয়ায়। সর্বহারা বাস্তুহারার স্রোত মিশল কালের স্রোতে। মধ্য আগস্টের এই মধ্যরাত্রির পর থেকেই আফগানিস্তান জুড়ে তৈরি হলো নৈরাজ্য, নৈরাশ্য; নেই সংবিধান। প্রায় ৪০ মিলিয়নের দেশ আফগানিস্তানে অধিকাংশ মানুষই রয়েছেন খাদ্য সংকটে। মহিলারা প্রায় গৃহবন্দী। নাবালিকাদের জন্য উচ্চশিক্ষা বন্ধ। অন্যদিকে আল কায়েদা, আইএসআইএসসহ অন্যান্য উগ্রপন্থী সংগঠনের আস্তানা আরো মজবুত হল। প্রায় চলছে যুদ্ধ। আল-কায়েদার নেতা আল জাওয়াহিরির নিধন দেখিয়ে দিয়েছে তালিবান শাসিত আফগানিস্তান জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছে ঠিক কতখানি নিরাপদ আশ্রয়।
প্রথম মধ্যরাত্রি থেকে আমরা পেরিয়ে এসেছি ৭৫ বছর। ভারত অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে এলেও সামাজিক ক্ষেত্রে রয়ে গিয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। মধ্যরাত্রি দুই অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যরাত্রি থেকে পেরিয়ে এসেছি ৪৭ বছর। এখনও বঙ্গ বন্ধুর (কয়েকজন) হত্যাকারী অধরা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ পুরোপুরি তার অবয়ব পায়নি এখনও। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নতুন উচ্চতা মেপে নিলেও এখনো দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক বাধা। খুব দ্রুত এগুলিকে নিষ্পত্তি করাই হবে আবশ্যিক।
অন্যদিকে, সবচেয়ে উদ্বেগের মধ্য আগস্টের তৃতীয় মধ্যরাত্রি। সর্ব সাম্প্রতিকতম কাবুলের গত বছরের মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেল এক বছর। মানুষের কাছে খাদ্য নেই, নিরাপত্তা নেই, নেই ন্যূনতম সুযোগ। ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কাতার, তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশ আফগানিস্তানের পাশে এগিয়ে এলেও, আফগানিস্তান রয়ে গিয়েছে অমানিশায়। তাদের উগ্র ভাবমূর্তি থেকে তালেবান সরে না এলে এবং দেশের একটি প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতান্ত্রিক কাঠামোর সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে, লাখো আফগানদের ভবিষ্যৎ কঠোরতর হতে থাকবে। আফগানিস্তানের ২০২১ সালের ১৫ আগস্টের সেই মধ্যরাত্রি গোটা দুনিয়ার কাছে হবে আরও এক বিভীষিকার নাম।
লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক এবং বিদেশনীতির গবেষক।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।