ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৬:৪৩, ২০ আগস্ট ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

মুঠোফোনের আদিমতম সংস্করণটি দেখেছিলাম তাঁর হাতে ১৯৯২ সালের কোন এক শীতের সকালে। তখন সবে আমি জাতিসংঘে যোগদান করেছি। সপরিবারে থাকি রুজভেল্ট দ্বীপে। তিনি আমাদের প্রতিবেশী। তাঁর নাম শুনেছিলাম আগেই, কিন্তু চাক্ষুষ দেখা সেই প্রথম।

সকালে দপ্তরে যাওয়ার সময়ে রুজভেল্ট দ্বীপের রাস্তায় বহু সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ এ দ্বীপে জাতিসংঘের বহু কর্মী থাকেন। ১৩শ মানুষের এ দ্বীপে ৫৭টি দেশের মানুষের বাস। সে দিনও যাচ্ছিলাম দপ্তরের দিকে। পথেই দেখা ইকবাল রিজার সঙ্গে, জাতিসংঘ মহাসচিব ব্রুটোস ঘালীর একান্ত সচিব। তাঁর সঙ্গে ভারী সম্ভ্রান্ত চেহারার এক আফ্রিকান ভদ্রলোক। সুঠাম দেহ, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, ভারী সুন্দর করে ফরাসী-ছাঁটা দাড়ি, প্রখর ব্যক্তিত্ব।

ইকবাল আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি কোফি এ্যানান। সে সময়ে তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিভাগের সর্বপ্রধান। পরিচয়ের সময়েই দু’টো মজার কথা তিনি আমাকে বললেন। এক, ঘানায় জন্মের দিন অনুসারে নামের প্রথম অংশটি নির্ধারিত হয়। তাই ‘বুধবারে’ যাঁদের জন্ম, তাঁরা সবাই ‘কোফি’। দুই, বেশীর ভাগ লোক তাঁর নামের শেষাংশ ‘আনন’ বলে উচ্চারণ করেন। সেটা ভুল। তাঁর নামের শেষাংশ ‘আনন’ নয়, ‘এ্যানান’। ‘অনেকটা cannon এর মতো,’ হেসে জানালেন তিনি।

নামের ব্যাখ্যার পরে কোফি এ্যানান ভারী মিষ্টি সম্ভাষণে আপ্যায়িত করলেন আমাকে, করমর্দনের সময়ে তাঁর হাতের উষ্ণতা আমি অনুভব করলাম, নানান খোঁজ-খবর নিলেন। লক্ষ্য করলাম তিনি ভারী নরম স্বরে কথা বলেন এবং একটি স্মিত হাসি সব সময়ে তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকে।

কোফি এ্যানানের কিছু দুর্লভ ছবি, শেষ ছবিতে সঙ্গী তার স্ত্রী।

কিন্তু সব ছাপিয়ে প্রথমেই যে জিনিষটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেটি হলো- তাঁর হাতের ঢাউস যন্ত্রটি - অনেকটা walkie-talkie'র মতো। কোফি এ্যানানের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। আমার তাকানো দেখেই তিনি বুঝে নিয়েছেন ঐ যন্ত্রের প্রতি আমার আগ্রহের ব্যাপারটি।

পূর্বী নদী পার হওয়ার শূন্যে-দুলুনী যানটিতে ওঠার পরে তিনি যন্ত্রটির ব্যাখ্যা দিলেন আমার কাছে। সেটি একটি মুঠোফোন। যেহেতু বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষী বাহিনীর খোঁজ-খবর সর্বক্ষণ তাঁকে রাখতে হয়, তাই ঐ দূরালাপনীটি তাঁর নিত্যসঙ্গী। ভারী যত্নের সঙ্গে আস্তে-ধীরে তিনি পুরো বিষয়টি আমাকে বোঝালেন - যেন কোন তাড়া নেই তাঁর, যেন সে মুহূর্তে সে ব্যাপারটি তাঁর কাছে পৃথিবীর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি অভিভূত হয়েছিলাম। তার পরের দিনগুলেতেও যতদিন তিনি আমাদের দ্বীপে ছিলেন, প্রায়শ:ই দেখা হতো, কথা হতো আমাদের দপ্তরে যাওয়ার পথে।

পরবর্তী সময়ে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব হলেন, রুজভেল্ট দ্বীপ ছেড়ে তিনি উঠে গেলেন ম্যানহ্যাটনে মহাসচিবের সরকারী বাসভবনে। তখন আর ততো দেখা হতো না, কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় নি। বেনু অসুস্থ হওয়ার পরে প্রায়ই খোঁজ-খবর নিতেন, বিশেষত: তাঁর স্ত্রী ন্যানা এ্যানান।

বেনু একটু ভালো হলে পরে এক বিকেলে চা’য়ে ডেকেছিলেন আমাদের দু’জনকে তাঁদের বাড়ীতে। সে বিকেলে অতি মায়া আর যত্নের সঙ্গে আমাদের আপ্যায়ন করেছিলেন ন্যানা ও কোফি এ্যানান। ন্যানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁর চিত্রকর্ম দেখিয়েছিলেন আমাদের। অত্যন্ত উঁচুদরের শিল্পী ছিলেন তিনি। তাঁদের ভালোবাসা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল।

পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ উন্নয়ণ কর্মসূচীর দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পরে পেশাগত দিক থেকে কোফি এ্যানানের সঙ্গে আমার সংযোগ আরো বেড়ে যায়, বিশেষত: সহস্রাব্দ উন্নয়ণ লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। বিভিন্ন সভায়-অনুষ্ঠানে দেখা হতো, প্রায়শ:ই যেতে হতো তাঁর দপ্তরে। দেখা হলেই বেনুর কথা বলতেন, আমাদের কন্যাদ্বয়ের খোঁজ-খবর করতেন, বাংলাদেশের নানান বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন। মনে আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল একদিন। তাঁর জ্ঞান, বোধ, সংবেদনশীলতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল সেদিন।

শেষ দেখা হয়েছিল বছর তিনেক আগে জেনেভায় জাতিসংঘ অফিসে। আমি ২০১৭ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বেরুচ্ছি। তিনি একটি উচ্চ-পর্যায়ের একটি সভা শেষ করে বেরুচ্ছেন। দরজার কাছেই দেখা। আমার সঙ্গে আমার জেনেভার সহকর্মীরা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর দলবল।

আমাকে দেখেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। পারিপার্শ্বিকতা ভুলে গিয়ে তাঁর স্বভাবের পরিপন্থী হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, কাজ থাকায় তিনি আমার অনুষ্ঠানে যেতে পারেন নি। কিন্তু লোকমুখে শুনেছেন যে, খুব ভালো বলেছি আমি। অভিনন্দন জানিয়ে যে কথাটি আমাকে তিনি বলেছিলেন, তা আমার আজো মনে আছে - ‘মাহবুব (প্রয়াত ড: মাহবুবুল হক) নেই, কিন্তু তাঁর শূন্যস্থান তো তুমি পূরণ করেছো।’

দু’জনেরই তাড়া থাকায় দ্রুত চলে যেতে হয়েছিল। শিগগিরই দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও নিয়ে সেদিন বিদায় নিয়েছিলাম। না, সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় নি। করাও যাবে না এ জীবনে আর।বছর খানেক পরেই তিনি প্রয়াত হলেন।

দু’দিন আগে ১৮ আগষ্ট কোফি এ্যানানের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস গেল। খুব নীরবে চলে গেলো দিনটি। আজ সকালেই বড় মনে হলো মানুষটিকে। কত স্মৃতি বয়ে গেল মনে শান্ত স্রোতের মতো। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, ‘কোফি এ্যানান নেই, কিন্তু তাঁর শূন্যস্থান কি পূরণ করা গেছে’?

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি