ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দশদিনে চার শিক্ষার্থীর আত্মহনন
প্রকাশিত : ২২:১৬, ২৩ নভেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ২২:২১, ২৩ নভেম্বর ২০১৮
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা। গত দশদিনের ব্যবধানে আত্মহত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষার্থী। তরুণ ও মেধাবী এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে একের পর এক অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ঘটনা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে সহপাঠী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী হুজাইফা রশিদ গতকাল বৃহস্পতিবার আত্মহত্যা করেছেন। এর আগে গত ১২ নভেম্বর বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ফাহমিদা রেজা সিলভী নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এর দু’দিন পর ১৪ নভেম্বর আত্মহত্যা করেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লাইলা আঞ্জুমান ইভা। এরপর গত ১৬ নভেম্বর মেহের নিগার দানি নামে ইংরেজি বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এ নিয়ে গত দশ দিনে বর্তমান ও সাবেক চারজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে তিনজনই নারী।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ ও হেনস্থার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আবার আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকটের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে। তাই আপন মানুষকে বিশেষ করে পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মত দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের পরিচালক ও অ্যাডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক বলেন, আমরা সবাই সচেতন হলে ঘটনাগুলো কমানো সম্ভব। কারো যদি আত্মহত্যা করার মত অবস্থা হয়, তাহলে তার বন্ধুদের উচিত গায়ে হাত রাখা এবং তাকে বুঝানো যে পৃথিবীতে তোমার বেঁচে থাকা কতটা দরকার।
তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যাই একমাত্র সমাধান নয়। বরং সেটি নিজেকে একেবারেই শেষ করে ফেলে। তাই বিষণ্নতা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে এবং তাদের সেদিকে পরিচালিত করতে হবে। বিশেষ করে পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মেহেদি হাসান অনিক বলেন, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে ভর্তি হওয়ার পর অনেক শিক্ষার্থী মনে করে জীবনের অনেক কিছু পেয়ে গেছি।কিন্তু লেখা-পড়ার মাঝে বাস্তব জীবন যখন তাদের কাছে কঠিন হয়ে পড়ে তখনই এমন ঘটনা ঘটে।এ থেকে মুক্তি পেতে শিক্ষার্থীদের চাকরির নিশ্চয়তার পাশাপাশি সব ধরণের হতাশার ক্ষেত্রে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
হুজাইফা রশিদের সহ-পাঠী আমিনুল ইসলাম রাফি জানান, ‘বৃহস্পতিবার দুপুরে হুজাইফা টঙ্গিতে তার নিজ বাড়ির কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। হুজাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দু’বার ইয়ারড্রপ করেছিল। পুনরায় ভর্তির পর এবছরও ঠিক মতো ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এ নিয়ে তাকে কিছুটা হতাশ মনে হতো”।
গত ১৬ নভেম্বর দুপুরে যশোরের নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন মেহের নিগার দানি। দানির আত্মহত্যার কারণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে তার বন্ধুদের এড়িয়ে চলতেন বলে জানা গেছে। বন্ধুদের ভাষ্যমতে তিনি প্রায় সময় একা ও মনমরা থাকতেন।
তার আগে ১২ নভেম্বর বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফাহমিদা রেজা সিলভি আত্মহত্যা করেন। প্রেমঘটিত কারণে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা করা হয়। সিলভির অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর শোক যেতে না যেতেই ১৪ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে আত্মহত্যা করেন ঢাবি অধিভুক্ত গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী লায়লা আঞ্জুমান ইভা। ইভা প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে বলে ধারণা প্রকাশ করে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) খন্দকার হেলাল উদ্দিন।
গণমাধ্যমকে জানান, আজিমপুরের শেখ শাহবাজার এলাকায় একটি বাসার নিচতলায় ইভা ও আরেক ছাত্রী ভাড়া থাকতেন। রাতে ওই বাসায় জানালার গ্রিলের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দেন ইভা। ইভার মৃত্যুর পরের দিনই অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর রাতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ঢাবির আরেক ছাত্র। তবে বন্ধু ও হলের অন্য শিক্ষার্থীদের তৎপরতায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ওই শিক্ষার্থী।
এর আগে চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগের একটি মসজিদ ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তরুণ হোসেন। তরুণের পর ৩১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ ভবনের নয়তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের শিক্ষার্থী তানভীর রহমান আত্মহত্যা করেন। তার সহপাঠীদের বক্তব্য, তানভীর সরকারি চাকরি না পাওয়ায় হতাশায় ভুগছিলেন।
মার্চে তানভীরের মৃত্যুর পর চার মাস বাদে শুরু হয় একের পর এক ধারাবাহিক আত্মহত্যার ঘটনা। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং চলতি নভেম্বর পর্যন্ত ৬ জনের আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৫ আগস্ট দেশের শিক্ষা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ থেকে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আত্মহত্যা করেন ঢাবির সঙ্গীত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিক মাহবুব। ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার একটি বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আফিয়া সারিকা আত্মহত্যা করেন। এরপর ১৫ অক্টোবর অভাবের তাড়নায় সুইসাইড নোট লিখে জাকির হোসেন নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী নিজ ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রাব্বানি বলেন, শিক্ষার্থীদের এমন মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। আমরা প্রতিটি বিভাগের ক্লাস প্রতিনিধিদের নিয়ে বসব। সহপাঠীর হতাশায় সহপাঠীরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। যারা হতাশ সেসব শিক্ষার্থীকে বলব আমাদের কাউন্সিলরদের সঙ্গে তারা যেন যোগাযোগ করে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তারা যেন অন্তত একবার তাদের সঙ্গে কথা বলে।
আরকে//
আরও পড়ুন