ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

দার্শনিকের দর্শন ও অদার্শনিকের দর্শন: একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:৪৪, ২০ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৮:৪১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

Ekushey Television Ltd.

বিস্ময়, সংশয় ও কৌতূহল থেকেই দর্শনের যাত্রা শুরু বলা যায়। মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতেই বিভিন্ন মৌলিক সমস্যা নিয়ে তারা কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। আর এভাবেই বিভিন্ন মত ও পাল্টা মতের উদ্ভব হয়েছে। যেগুলো পরবর্তীতে বিভিন্ন পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত হয় এবং সমৃদ্ধ করেছে দর্শনের ইতিহাসকে। দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে জ্ঞানবিদ্যা। যেখানে জ্ঞান সম্পর্কীয় বিভিন্ন বিষয় যেমন- জ্ঞানের পদ্ধতি, জ্ঞানের উৎপত্তি, জ্ঞানের সরূপ ও বিষয়বস্তু, জ্ঞানের ক্যাটাগরি, সত্য-মিথ্যা নিরূপণের প্রশ্ন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। দর্শনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিগত আলোচনার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, কেননা দর্শন মৌলিক সমস্যাবলীর বিচারমূলক অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকে। আর এ কারণে বিভিন্ন ধারণার বিচার-বিশ্লেষণ এবং মৌলিক সমস্যাবলির সমাধানকল্পে বিভিন্ন পদ্ধতি এসেছে। যেসব পদ্ধতি হয় তার পরবর্তী দার্শনিকরে মধ্যে আরো বিকাশ লাভ করেছে কিংবা সমালোচিত হয়ে নতুন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে। এই পদ্ধতিগত আলোচনার যাত্রা শুরু হয়েছিল (মনে করা হয়) খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে অর্থাৎ থেলিসের (৬৫০-৫৪৬) সময় থেকে। থেলিসই প্রথম এ জগতের মৌলিক উপাদান অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন- এ জগতের মৌলিক উপাদান কি বা এ জগতের উৎপত্তি কোথা থেকে? তখন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত দর্শনের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বেশ জটিল ও বিতর্কমূলক বিষয় নিয়ে আলোচিত হয়েছে। আর এ যাত্রাপথ সাধারণ মানুষের অনন্ত কৌতূহলের সমাধান দিতে চেষ্টা করেছে বারবার। যে বিষয়টির গুরুত্ব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরে ২০০২ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব দর্শন দিবসের ঘোষণা দেয়। যা পরবর্তীতে ২০০৫ সালে ইউনেস্কোর এক সাধারণ সভায় প্রতি বছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহষ্পতিবার বিশ্ব দর্শন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর সেই প্রতীক্ষিত বিশ্ব দর্শন দিবস।

যেহেতু দর্শন মানুষের জন্য ও জীবনের জন্য তাই সকলের দর্শন চর্চার অধিকার রয়েছে। আর পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, দার্শনিক  হওয়ার জন্য দর্শনের ছাত্র হওয়া আবশ্যক নয়। দর্শন চর্চা করেও একজন অদার্শনিক থেকে যেতে পারেন, আবার দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন না করেও একজন দার্শনিক মনন ধারণ করতে পারেন। দর্শন বিষয়ে যে ভুল তত্ত্ব প্রচার হয় সে দায় আসলে কিছু অ-দার্শনিক সম্প্রদায়ের (তারা দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন করাও হতেও পারেন আবার নাও পারেন)। দর্শনকে যারা অন্ধকার ঘরে অস্তিত্বহীন কালো বিড়ালের সাথে তুলনা করেন তারা আসলে দর্শন বিষয়ে জানেন না। কিছু উাহরণের সাহায্যে এমন উদ্ভট প্রচারের বিরোধিতা করা যাক- ‘দর্শনের বিষয়বস্তুকে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে মূল্যবিদ্যা একটি। এই মূল্যবিদ্যারই একটি শাখামাত্র তর্কশাস্ত্র বা ন্যায়শাস্ত্র বা যুক্তিবিদ্যা। কিছু অ-দার্শনিক আছেন যারা নিজেদের অতি পণ্ডিত ভেবে দর্শনের ছাত্ররে কটাঙ্ক করেন বিভিন্ন অবৈধ যুক্তি দিয়ে। যেখানে তারা এটা উপলব্ধিই করতে পারেন না যে যুক্তির একটা কাঠামো আছে, একটা নিয়ম আছে। তারা বরং এমন সব যুক্তি দিয়েই ব্যাঙ্গ হাসি দিতে থাকেন যে- “গরু ঘাস খায়, মানুষ গরু খায়, অতএব মানুষ ঘাস খায়।”  তারা আসলে নিজেদের জানাকে সঠিক ভেবেই এমন সব উদ্ভট যুক্তি দিতে থাকেন। কিন্তু তাদের জানা উচিত যে, ন্যায় বা যুক্তির ক্ষেত্রে আকারগত সত্যতা ও বস্তুগত সত্যতা বলে কিছু ধারণা আছে। বীজগণিতের মত মধ্যপদের মাধ্যমে প্রধান পদ ও অপ্রধান পদের মধ্যে একটা আবশ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপার আছে। দর্শনের মর্যাদাকে হেয় করার প্রয়াসে অ-দার্শনিকের আরো এমন অভিযোগ আসে যে, ‘দর্শন কেবল সমস্যার কথা বলে, সমাধানের পথ বলে দেয়না’। এখানেও সার্বিকভাবে সাধারণীকরণ করা হয়েছে দর্শনকে। পৃথিবীর কোন বিদ্যা আছে যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হচ্ছেনা? আরো উন্নততর রূপ পাচ্ছেনা? আপেক্ষিকতাবা অনূসারে সব কিছুই পরিবর্তনশীল। তাই যেখান থেকে র্শনের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা যতই পরিবর্তিতই হোক না কেন, প্রতিটি নতুন তত্ত্বই করেছে এক একটি নতুন যুগের সূচনা, দিয়েছে নতুন জ্ঞানের দ্বার উন্মোচন করে। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছে দর্শন আর বিজ্ঞান পেয়েছে নতুন গবেষণার উপাদান। প্রকৃত দার্শনিক প্রশ্ন করেন, অনুসন্ধান করেন, ব্যাখ্যা করেন, মূল্যায়ন করেন ও সবশেষে তত্ত্ব দেন এবং তা সকলের সমালোচনার জন্য উন্মোক্ত রাখেন। যে কারণে দর্শন হয়ে উঠে জ্ঞানের আঁধার, অজ্ঞানের এক আলোকবর্তিকা। তাই আজ দর্শন দিবসে এই আবেদন থাকবে বিশ্বব্যাপী-দর্শন জানুন, চিন্তা করুন, সঠিক পদ্ধতিতে সত্যের কাছে পৌঁছান এবং একজন দার্শনিকের মনন তৈরী করুন। দর্শন আপনাকে সমস্যা নয় কেবল, সমাধানের পথও বলে দিবে।

 

লেখক: ফরহাদ আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি