ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

দীপনের জন্যে ভালোবাসা

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৮:৪৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

সংবাদটা জেনে সকাল থেকেই নিশ্চুপ হয়ে ছিলাম। কেমন এক ধূসর বিষন্নতা আমাকে আচ্ছন্ন করছিল- কুয়াশা যেমন আমাদের চারপাশকে ঘিরে রাখে। সবই করছিলাম, কিন্তু কেমন এক ডালে বসা পাখির অন্যমনস্কতা নিয়ে। বৃষ্টির ফোঁটার মতো কষ্টের দানাগুলো হৃদয়ের জমিনে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছিল যেন। দীর্ঘ ছ’বছর পরে আজ দীপন-হত্যা মামলার রায় বেরুলো।

আমার মনে তিনটে ভাবনার তোলপাড়। প্রথমত, মামলার রায় বিষয়ে আসামি পক্ষের কৌঁসুলীরা বলেছেন, ‘তারা এ রায়ে সন্তুষ্ট নন’। তাদের মনে রাখা উচিত- বিচার অন্ধ, নির্মোহ এবং নির্মমও বটে। কারও সন্তুষ্টি বিধান কোনও বিচারের রায়ের উদ্দেশ্য নয়। আসামি পক্ষের কৌঁসুলীরা তো দূরের কথা, রায় প্রদানকারী বিচারক, এমনকি দীপনের পরিবারের সন্তুষ্টিবিধান করাও এ রায়ের উদ্দেশ্য নয়। বিচারের রায়ের মূল লক্ষ্য হচ্ছে- ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা- নির্মোহ এক অনপেক্ষ ন্যায়কে নিশ্চিত করা। কারও সন্তুষ্টিবিধানে বিচারের রায় প্রদত্ত হলে তা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং আসামি পক্ষের কৌঁসুলীদের এ জাতীয় কথা না বলাই বাঞ্ছনীয়।

আজ অবয়বপত্রে দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলি লিখেছেন- দীপন হত্যা রায় সম্পৃক্ত বিষয়ে। না, আবেগতাড়িত হয়ে লেখেন নি, অত্যন্ত বিবেক চালিত হয়ে লিখেছেন। জলি বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন সংবাদ মাধ্যমগুলোর সংবেদনশীলতার অভাব ও বিবেচনার ঘাটতির মতো বিষয়গুলো। সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বলি, ‘আপনাদের জন্যে এটা নিছক সংবাদ, কিন্তু দীপন পরিবারের জন্যে এটা জীবন-মরণ। দু’দিন পরে আপনারা নতুন সংবাদ খুঁজবেন, কিন্তু দীপনের পরিবারকে সারা জীবন এ বেদনা কুরে কুরে খাবে। 

চাঞ্চল্যকর সংবাদের দৃষ্টিকোণ থেক নয়, মানবিকতার আতশ কাঁচ দিয়ে বিষয়টিকে দেখুন। দীপনের মাতা-পিতা, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের কথা ভাবুন। দীপন হত্যার পরে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া তাঁর পিতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দু:খে-ক্ষোভে বলেছিলেন, আমি আমার পুত্র হত্যার বিচার চাই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতুল্য এবং এক সময়ের সহকর্মী সর্ব অর্থেই এ ঋজু মানুষটি কোন বেদনায় এমন কথা উচ্চারণ করেছিলেন, তা আমরা কোনওদিনই বুঝতে পারবো না। 

দীপন ও জলির সন্তানদের কথা ভাবুন। আজ তারা আপনাদের মানবিক সংবেদনশীলতা ও বিবেচনা প্রত্যাশা করে। সুতরাং জলির অনুরোধ মেনে নিয়ে তাঁদেরকে তাঁদের কষ্টের জায়গাটুকু ছেড়ে দিন। এ টুকু সম্মান, সহানভূতি ও বিবেচনা তাঁদের নিশ্চয়ই প্রাপ্য।’

আজ সারাদিন জলির দু’টো কথা ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়েছে’ আমার মনে। ‘যার যায়, তারই যায়’ এবং ‘কোনও রায়ই দীপনকে ফিরিয়ে দেবে না’। কথাগুলোর অন্তর্নিহিত সত্যতা প্রশ্নাতীত, কিন্তু একটু ভাবলেই সে উচ্চারণের পেছনে গভীর বেদনা এবং অব্যক্ত সুপ্ত এক অভিমান অনুরণিত হয়- অনেকটা সেই ‘দু:খ, সে আমারই থাক, পাতার নীচে ছাতার মতো, পরম ব্যাপ্তিতে।’

এ দু:খ, বেদনা, কষ্টের জায়গাটি আমরা কেউই ছুঁতে পারবো না, বোঝা তো দূরের কথা। আমরা শুধু নত মস্তকে নিশ্চুপ হয়ে দীপনের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাঁদের হাত নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারি। নিস্তব্ধতারও একটি ভাষা আছে- বোধের, উপলব্ধির, ভালবাসার। দীপন যেখানে আছে, সেখানে হয়তো কিছুই পৌঁছায় না- ভালবাসাটুকু ছাড়া। নইলে জীবন চলে কি করে? দীপনের জন্যে সেটুকুই থাক।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি