দুইবার ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী
প্রকাশিত : ১৮:১৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ | আপডেট: ১০:৫৭, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২
দুইবার ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী
যুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে কোনো যোদ্ধাকে একই পদক দুইবার দেয়া হলে তার নামের শেষে ‘বীরত্ব’ উপাধি লেখার পর প্রথম বন্ধনীতে ‘বার’ লেখা নিয়ম রয়েছে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা জহুরুল হক মুন্সীই একমাত্র বীর মু্ক্তিযোদ্ধা, যিনি দুইবার ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছেন।
প্রথম মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির (এমএলআই) ডাকনাম ছিল ‘জঙ্গী পল্টন’। ১৯৭১-এর ৮ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জঙ্গী পল্টনের হয়ে প্রায় সব যুদ্ধেই অংশ নিয়েছেন জহুরুল হক মুন্সী।
১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জামালপুরে পাকিস্তানি গ্যারিসনে ৩১ বেলুচের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের জন্য আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানানো চিঠি নিয়ে যান তিনি। কৃষকের ছদ্মবেশে সাদা পতাকা উড়িয়ে সাইকেল চালিয়ে কমান্ডার মুন্সী সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যেদের কাছে গিয়ে যখন চিঠিটি হস্তান্তর করেন, তখনই তার ওপর পাশবিক নির্যাতন শুরু হয় । নির্যাতনের মুখে কৌশলের আশ্রয় নেন কমান্ডার মুন্সী । ভাঙা ভাঙা উর্দুতে পাকিস্তানিদের বুঝাতে সম্মত হন, তিনি একজন দরিদ্র কৃষক। ভারতীয়রা তাকে বাধ্য করেছে এখানে আসতে। পরে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ফিরতি চিঠিসহ ছেড়ে দেয়া হয়।
কমান্ডার মুন্সী জানান, সাইকেলে করে ফেরার পথে রাস্তার দুই পাশে গণহত্যার ভয়াবহ আর হৃদয়বিদারক সব দৃশ্য চোখে পড়ে। চোখে পড়ল রাস্তার দুপাশে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ।
এ রকম অসংখ্য মৃতের মিছিল পেরিয়ে মাঝরাতে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে ফিরে আসেন কমান্ডার মুন্সী। পাকিস্তানিরা ফিরতি চিঠিতে একটি ৭.৬২ মিমি চায়নিজ রাইফেলের গুলি মুড়ে দিয়েছিল আত্মসমর্পণ না করার ইঙ্গিত দিয়েছিল। কমান্ডার মুন্সীর কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার পরপরই প্রথম মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির কমান্ডিং অফিসার ভোররাতেই গ্যারিসন দখলের সিদ্ধান্ত নেন ।
পরদিন পাকিস্তানি গ্যারিসন দখলের যুদ্ধে কমান্ডার মুন্সি রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি কমান্ডার মুন্সীর মনোজগত্টাই বদলে দিয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যের লাশের স্তূপ তৈরি করে তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মুন্সীকে সেদিন কোনোভাবে থামাতে পারছিলেন না সহযোদ্ধারা! সৈন্যের মৃতদেহসহ বিপুল অস্ত্রশস্ত্র মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয় ।
১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে নির্বিচার বাঙালি নিধন শুরু হলে ২৭ মার্চ জহুরুল হক মুন্সী ঢাকার নারায়ণগঞ্জে স্থানীয়দের সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধে শরিক হন। এরপর সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ভারতে পৌঁছে যান। ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে বিএসএফের তত্ত্বাবধানে মৌলিক যুদ্ধ ও বিস্ফোরক বিষয়ে নেন প্রাথমিক ও বিশেষ প্রশিক্ষণ। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ভারতীয় বিএসএফকে পথ দেখিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে কামালপুর-বকশীগঞ্জ হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত একাধিক সেতু ধ্বংস ও রাস্তা কেটে দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে অংশ নেন।
জহুরুল হক মুন্সীর মুখ থেকে তার যুদ্ধদিনের লোমহর্ষক সব অভিজ্ঞতা শুনতে গিয়ে জানা যায় শ্রীবরদীর একটি বড় বটগাছের তিনজন পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখেছিলেন গ্রামবাসীর মনোবল ধরে রাখতে আর মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার জন্য।
শেরপুরের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টাকার প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়েছিল কামারুজ্জামানের পরিবর্তে তারই এক সহযোগী কামরানকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অপরাধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু দেশপ্রেম থেকে একটুও টলানো যায়নি তাকে।
বিজয়ের মাসে জহুরুল হক মুন্সীসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সশ্রদ্ধ সালাম।