ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪

দুধ নিয়ে হাইকোর্টের রুল

প্রকাশিত : ১৩:৩৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ১৬:০২, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গরুর দুধ, খাদ্য এবং দই জরিপ করে ২ সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে জাতীয় খাদ্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে দুদক চেয়ারম্যানকেও তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সোমবার বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বে দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। পাশাপাশি দুধে ভেজাল দেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের কেন সর্বোচ্চ শাস্তির দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এছাড়া বাজারে গরুর প্যাকেটজাত তরল দুধ মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক, সীসা ও অ্যান্টোবায়োটিক পাওয়ার ঘটনায় কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ নয় জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে দেওয়া এ আদেশে আদালত বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ। বাজারে গাভীর তরল দুধে, দইয়ে মাত্রাতিরিক্ত সিসা অ্যান্টোবায়োটিক, মানব স্বাস্থ্যোর জন্য ক্ষতিকর কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

এর আগে গণমাধম্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাজারের তরল খোলা দুধে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক, সীসা ও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের উপাদান পাওয়া গেছে। গবেষণায় এ সব উপাদানের পাশাপাশি দুধে পাওয়া গেছে আলফাটক্সিন এবং বিভিন্ন অণুজীবও।    

সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আওতাধীন ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) গবেষণায় এ সব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গাভির খাবার, দুধ, দই ও প্যাকেটজাত দুধের ওপর এই গবেষণা পরিচালনা করে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, প্যাকেটজাত গাভির দুধেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ও সীসার অস্তিত্ব। এমনকি সাধারণ দোকানের দই থেকে শুরু করে নামি-দামী প্রতিষ্ঠানের দইয়েও মিলেছে অতিরিক্ত সীসা-অনুজীব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনও খাবারের মধ্যেমে শরীরে যদি মাত্রাতিরিক্ত সীসা, আলফাসক্টিন এবং কীটনাশক প্রবেশ করে তাহলে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ সাময়িক বা স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে পড়তে পারে। কিডনি বিকল বা ক্যান্সারের মতো রোগ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

তাছাড়া অনুজীব থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে নানা ধরনের রোগ। খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের মাধ্যমে মানবদেহ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে। ফলে একটা পর্যায়ে গিয়ে রোগ প্রতিরোধে কোন অ্যন্টিবায়োটিক আর কার্যকর হবে না।

এনএফএসএল সূত্র জানায়, এই গবেষণায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গাভির দুধের ৯৬টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ঢাকাসহ তিন জেলার ছয়টি উপজেলাসহ ১৮টি স্থান থেকে দুধের পাশাপাশি অন্যান্য নমুনাও সংগ্রহ করা হয়।

গাভির দুধ ও গোখাদ্য সরাসরি খামার থেকে সংগ্রহ করা হয়। দই ঢাকা শহরের বিভিন্ন নামী-দামী দোকান ও আশপাশের উপজেলা পর্যায়ের সাধারণ দোকান থেকে সংগ্রহ করা হয়।

বিভিন্ন সুপার স্টোর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত তরল দুধ এবং আমদানি করা প্যাকেট দুধ। এগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে ল্যাবরেটরিতে পৌঁছানোর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে।

গবেষকরা জানান, প্রায় সব গোখাদ্যে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কীটনাশকও মিলেছে কোনও কোনও খাবারে। রয়েছে সিসা ও ক্রোমিয়ামও।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গোখাদ্যের ৩০টি নমুনা গবেষণা শেষে দেখা গেছে, এর মধ্যে কীটনাশক ২ নমুনায়, ক্রোমিয়াম ১৬টি নমুনায়, টেট্রাসাইক্লিন ২২টি নমুনায়, এনরোফ্লোক্সাসিন ২৬টি নমুনায়, সিপ্রোসিন ৩০টি নমুনায় এবং আফলাটক্সি ৪টি নমুনায় গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রা পাওয়া গেছে।

গাভির দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯ শতাংশ দুধে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কীটনাশক, ১৩ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিন, ১৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় সিসা এবং ৩ শতাংশ দুধে গ্রহনযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় আলফাটক্সিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ৯৬ শতাংশ দুধের নমূনায় মিলেছে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব।

প্যাকেটজাত দুধের ৩১টি নমুনায় ৩০ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হারে আছে টেট্রাসাইক্লিন। কিছু নমূনায় পাওয়া গেছে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ও এনরোপ্লোক্সাসিন। একটি নমুনায় পাওয়া গেছে মাত্রতিরিক্ত সিসা। এছাড়া ৬৬ থেকে ৮০ শতাংশ দুধের নমুনায় বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতি স্পষ্টত প্রতিয়মান।

গবেষণায় দইয়ের ৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। যার একটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ সিসা পাওয়া গেছে। আর ৫১ শতাংশ নমুনায় মিলেছে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব।

এনএফএসএলের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী জানান, খোলা দুধে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক শুন্য শতাংশ অনুজীব গ্রহণযোগ্য। তবে গবেষণায় দেখা গেছে এ সব দুধ ও দগ্ধজাত খাদ্যে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ বিভিন্ন অনুজীব রয়েছে। এমনকি ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ মারাত্মক ক্ষতিকর ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

তিনি জানান, খাদ্যে সীসার গ্রহণযোগ্য মাত্রা সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত। টেট্রাসাইক্লিনি পাওয়া গেছে ১৮ দশমিক ৭২ শতাংশ থেকে ১৬১ দশমিক ১৩ শতাংশ পর্যন্ত। আর বিভিন্ন ধরনের কীটনাষক পাওয়া গেছে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ পর্যন্ত।

অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী আরও জানান, এছাড়া গো-খাদ্যে ১৩২৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ সীসা, ৮৮ দশমিক ১৫ শতাংশ ক্যাডমিয়াম, ৩৬০১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ ক্রোমিয়াম, ২০ দশমিক ৮৫ শতায়শ আলফাটক্সিন, ২৩৮২৫ দশমিক ৮০ শতাংশ টেট্রাসাইকিলন, ২২৬৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এনরোফ্লোক্সাসিন ৬১১৬ দশমিক ১৭ শতাংশ সিপ্রোফ্লক্সিন এবং ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশ কীটনাশক পাওয়া গেছে।

এনএফএসএলের গবেষণায় দুধ ও দইয়ে যে সব ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে সেগুলো ক্ষতিকর কি না জানতে চাইলে আইইডিসিআর’র প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, শরীরে মাত্রতিরিক্ত সীসা, আলফাসক্টিন এবং কীটনাশক প্রবেশ করে তাহলে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ সাময়িক বা স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে পড়তে পারে।

তিনি বলেন, কিডনি বিকল বা ক্যান্সারের মতো রোগ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাছাড়া অনুজীব থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে নানা ধরনের মারাত্মক রোগ। খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহনের মাধ্যমে মনবদেহ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে। একটা পর্যায়ে গিয়ে রোগ প্রতিরোধে কোন অ্যন্টিবায়োটিক আর কার্যকর হবে না। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্সমতা নষ্ট হয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হবে, যখন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে আর রোগ সারানো সম্ভব হবে না।

অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া ডায়রিয়া বা মারাত্মক পানিশুন্যতার সৃষ্টি করে। ইতিপূর্বে তরমুজে ই-কোলাই থাকায় এক পরিবারের কয়েকজন সদস্য মৃত্যুবরণ করে। একইভাবে কীটনাশক মারাত্মক বীষ। ইতিপূর্বে লিচুতে কীটনাশক থাকায় সেই লিচু খেয়ে কয়েকটি শিশুর প্রাণহানী ঘটে।

গতকাল রোববার রাজধানীর মহাখালীস্থ জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ন্যাশনাল ফুড সেইফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) আইএসও সনদ অর্জন এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাবারের মানসম্পর্কিত গবেষণা কাজের ফলাফল প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এ সব তথ্য জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যানমন্ত্রী জাহিদ মালেক। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যনা প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) হাবিবুর রহমান, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক নির্মলেন্দু চৌধুরী।

একে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি