দুবাইতে নিহত ৫ রেমিট্যান্স যোদ্ধা নিজভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত
প্রকাশিত : ১১:২৫, ৩ আগস্ট ২০২৪
শুক্রবার বেলা আড়াইটা, সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় কয়েকশত উৎসুক মানুষ। সবাই দৃষ্টি তখন প্রধান সড়কের দিকে। কোন গাড়ি আসার শব্দ পেলেই তাকিয়ে দেখছে সবাই। এভাবে কেটে যায় প্রায় ১৫ মিনিট। ঘড়ির কাটা ঠিক তখন পৌনে ৩টা। একে একে সাইরেন বাজিয়ে লাশবাহী চারটা ফ্রিজিং এ্যাম্বুলেন্স এসে থামে ঢাকার নবাবগঞ্জের জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বালেঙ্গা গ্রামে।
এ্যাম্বুলেন্সকে ঘিরে তখন উৎসুক জনতার ভিড়। প্রিয় মানুষের মরদেহ এসেছে বাড়ির আঙ্গিনায় জানতে পেরে স্বজনরাও ছুটে এসেছে। একে একে নামানো হলো কফিন বন্দি লাশগুলো। স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে পুরো এলাকা। স্বজনদের কান্না দেখে কাঁদের উপস্থিত অনেকে।
গত ৭ জুলাই দুবাইয়ের আজমান প্রদেশে গাড়ি বিস্ফোরণে নিহত ৫ জনের মধ্যে চারজনের বাড়িই বালেঙ্গা গ্রামে। শুক্রবার নিহত ৫ জনের মরদেহ দেশে আসে।
দুর্ঘটনায় নিহত রানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠানে দাঁড়ানো জায়গাটুকু নেই। আত্মীয় স্বজনদের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার মানুষ ছুটে এসেছে শেষ বারের মত রানাকে এক নজর দেখতে। রানার বাবা কান্নাজনিত কন্ঠে জানান, অনেক স্বপ্ন নিয়ে রানাকে বিদেশ গিয়েছিল। আগামী ডিসেম্বর ওর দেশে আসার কথা ছিল। ছেলে আমার ৫ মাস আগেই বাড়িতে এলো, তবে নিথর দেহে।
তিনি আরও জানান, আগামী ডিসেম্বরে দেশে এসে নববধূকে ঘরে তুলবেন এমন স্বপ্ন ছিল রানার। পরিবার থেকে পাত্রী দেখে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতিও নিয়েছিল পরিবারটি। তবে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে যায় রানা ও তার পরিবারের স্বপ্ন।
রানার মা রৌশনারা রুসি ছেলের কফিন ধরে চিৎকার করে বিলাপ করে বলেন,“অপেক্ষায় ছিলাম কবে আইবো আমার বাবা। বুঝতে পারি নাই, এত তাড়াতাড়ি চলে আইবো। আমি তোকে এভাবে আইবার কই নাই বাবা। ঐ রানা তুই কফিন থেকে বের হয়ে আয়। একটু আয় না বাবা, মা কোলে। তোকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো।”
রানার মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা ছিল না উপস্থিত কারও। পরিবারের আদরের সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক পুরো পরিবার।
রানার সাথে একই ঘটনায় নিহত হন তার গ্রামেরই আব্দুল হাকিমের ছেলে মো. রাশেদ, শেখ ইরশাদের ছেলে মো. রাজু ও শেখ ইব্রাহীমের ছেলে ইবাদুল ইসলাম। নিহত এ তিন যুবকের বাড়িতেও ছিল স্বজনদের আহাজারি।
পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা রাশেদের পরিবার। ছেলের লাশবাহী কফিন ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন মা ইয়ারন বেগম। নির্বাক হয়ে গেছেন স্ত্রী বৃষ্টি আক্তারও। স্থানীয়রা জানান, মাত্র ৫ বছর বয়সে বাবাকে হারান রাশেদ। এরপর মা কষ্ট করে বড় করেছিলেন রাশেদ ও তার দুইবোনকে। রাশেদের মত তার সন্তান রেজুও মাত্র সারে ৪ বছরে তার বাবাকে হারালেন। রাশেদকে ছাড়া কিভাবে চলবে রাশেদের সংসার ভেবে পাচ্ছে না প্রতিবেশিরা।
সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আরেক যুবক ইবাদুলের মা নাজমা বেগম। ভাইয়ের মরদেহের পাশে দাড়িয়ে কান্না করছিলেন দুই ভাই কামরুল ও ইব্রাহীম। অভাবের সংসারের সুখের আশায় এক বছর আগে ঋণ করে ভাইকে বিদেশ পাঠিয়েছিলেন তারা। তবে সুখের দেখা পাওয়ার আগেই ভাইয়ের মরদেহ এসে পড়েছে বাড়িতে। কান্নাজনিত কন্ঠে দুই ভাই বলেন, ভাবতেই পারছি না আমার ভাই আর নেই। ওর চিন্তায় মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
রাজুর বাড়িতেও চলছে কান্নার রোল। স্বামীর লাশ দেখে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন অন্তঃসত্বা স্ত্রী ফারজানা আক্তার। পরিবার সূত্রে জানা যায়, মাত্র ৬ মাস আগে রাজু ও ফারজানার দিয়ে হয়। দুর্ঘটনার চার মাস আগে রাজু দুবাই চলে যায়। স্বামীকে হারিয়ে নির্বাক ফারজানা। এসময় রাজুর মা আছিয়া বেগমের বুকফাটা কান্নার ভারি হয়ে উঠে পরিবেশ। তিনি বুক চাপড়ে বার বার বলছিলেন, তোমরা আমার রাজুর কফিনটা খুলে দাও। আমি ওর মুখটা শেষ বারের মত দেখি।
এদিকে, একই দুর্ঘটনায় নিহত হন দোহার বাজার এলাকার হিরা মিয়া। তার লাশও এসেছে বাড়িতে। ছেলের লাশ থেকে নির্বাক বাবা মঞ্জুল মিয়া। কথা না বললেও তার দুই চোখ বেড়ে ঝড়ছিল পানি। তিনি বলেন, আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। ছেলে হারিয়ে এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কি হতে পারে।
জানা যায়, ৭ জুলাই রোববার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে দশটার দিকে রানা নিজেই প্রাইভেট গাড়ী চালিয়ে চারজনকে নিয়ে কাজে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে আজমান প্রদেশেই রাস্তায় একটি ডিজেল বহনকারী ট্যাংকারের সাথে ধাক্কা লেগে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় রানাসহ ৫ প্রবাসী। নিহতদের ৫ জনের মধ্যে নবাবগঞ্জের জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বালেঙ্গা গ্রামের চারজন ও দোহার উপজেলার দোহার বাজার এলাকার একজন।
নিহতরা হলেন, নবাবগঞ্জের বালেঙ্গা গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে মো. রানা (৩০), আব্দুল হাকিমের ছেলে মো. রাশেদ (৩২), শেখ ইরশাদের ছেলে মো. রাজু (২৪), শেখ ইব্রাহীমের ছেলে ইবাদুল ইসলাম (৩৪) এবং দোহার বাজার এলাকার মো. মঞ্জুর ছেলে মো. হিরা মিয়া (২২)। তাঁরা একই জায়গায় কাজ করতেন।
এরআগে শুক্রবার সকাল ৯টায় বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি কার্গবিমানে দেশে আসে নিহতদের মরদেহ। বেলা ৩টায় গ্রামের বাড়ি দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার বালেঙ্গায় আসে মরদেহগুলো। পরে বাদ আসর জানাজা শেষে স্থানীয় সামাজিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
এঘটনায় দোহার ও বালেঙ্গা এলাকায় হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
এএইচ
আরও পড়ুন