দুর্যোগের পর কেমন আছে উপকূলের শিশুরা
প্রকাশিত : ১৩:০০, ১ জুন ২০২৪
পড়ন্ত বিকালে শান্ত মেঘনা, ছড়াচ্ছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। অস্ত যাওয়া সূর্যের লাল আভায় মেঘনার পানিতে পা ভিজিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে কয়েক শিশু। কিন্তু অপরূপ সৌন্দর্যের এ মেঘনা দুইদিন আগেই রাক্ষসী রূপ দেখিয়েছে। কূলে বসবাসরত শিশুদের আশ্রয়স্থল কেড়ে নিয়েছে।
শান্ত মেঘনার তীরে খেলাধুলায় মেতে ওঠা শিশুরা মাঝেমধ্যে মেঘনার অশান্ত রূপও দেখে। ভয়ংকর রূপী মেঘনা ভয় ঢুকিয়ে দেয় কোমলমতি শিশুদের মনে।
সম্প্রতি উপকূলে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমাল ও মেঘনার জলোচ্ছ্বাসের ঘটনার বর্ণনা করেছে নদীর তীরে বেড়ে ওঠা শিশুরা। গত রোববার (২৬ মে) ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলে আঘাত হানে, সোমবার নদীতে দেখা দেয় জলোচ্ছ্বাস।
১০ বছরের শিশু জিহান। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার নাছিরগঞ্জ এলাকার মেঘনা নদীর তীরেই ছিল জিহানের বসতঘর। সে বসতঘরটি এখন আর নেই। কেড়ে নিয়েছে মেঘনায় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উত্তাল মেঘনার উপকূলে যখন জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে, সে সময় শিশু জিহান আশ্রয় নিয়েছে তার খালার বাড়িতে। মেঘনার তাণ্ডবের সময় ঘরে ছিল তার বাবা-মা। মালামাল হারানোর ভয়ে তারা অন্যত্র সরে যাননি। কিন্তু জলোচ্ছ্বাস তাদের পুরো ঘর কেড়ে নিয়েছে। জিহানের পরিবার এখন আশ্রয়হীন।
আপাতত কয়েকদিনের জন্য খালাদের বাড়িতেই থাকছে জিহানেরা। ছোট্ট জিহান বলে, ধমায় (ঢেউ) সব নিয়া গেছে। আমাদের ঘরটি পর্যন্ত নিয়ে গেছে। এখন খালাদের বাড়িতে থাকি।
স্থানীয় একটি মাদরাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র মো. রাশেদ (১১)। জলোচ্ছ্বাসের দিন আতঙ্কিত হয়ে পড়া এ শিশুটিও তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছে। শিশু রাশেদ জানালো, ‘অনেক ভয় লাগছে, বড় বড় ঢেউ হয়েছে। একেকটা ঢেউ অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। আমার বুক পরিমাণ পানি হয়েছে। ঢেউয়ে মনে হয় আমাদের নিয়ে যাবে, এমন আতঙ্কে ছিলাম। ’
পরিবারের কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি, তাই তারও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া হয়নি বলে জানায় শিশু রাশেদ।
আট বছরের শিশু রিয়ামনিদের ঘরের কিনারা পর্যন্ত পানি উঠেছে। বাতাসের তীব্র বেগে যেন তাদের ঘরটি ভেঙে পড়বে, এমন অবস্থা হয়েছিল। খুব আতঙ্কে ওই সময়টি পার করার কথা জানায় রিয়ামনি।
ইব্রাহিমের বয়স আট বছর। এ বয়সেই ভয়ংকর রূপ দেখেছে মেঘনার। ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় বাবা-মা ও তিন বোনের সঙ্গে ঘরেই ছিল সে। ঘরে পানি উঠে গেলে সবাই খাটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে এমন পরিস্থিতির মধ্যে কাটাতে হয়েছে তাকে।
১০ বছরের আকরাম, ১১ বছরের রিয়ান ও সাত বছরের নোহা আক্তার, সাত বছরের সালমান খানও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে খাটের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে ভয়ংকর সময় পার করেছে বলে জানিয়েছে। তারা বলে, জলোচ্ছ্বাসের সময় বড়দের বুক পরিমাণ পানি উঠে গেছে। আমাদের মাথার ওপর হবে। অনেক ভয়ে ছিলাম।
নদীর খুব তীরেই নুরজাহানদের ঘর। পাশের অনেক ঘর ভাসিয়ে নিয়েছে জলোচ্ছ্বাসের পানি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় নুরজাহান তার তিন বছর বয়সী নাতি সজীবকে নিয়ে ঘরেই ছিলেন। ঘরের মালামাল হারানোর ভয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠেননি। তবুও জলোচ্ছ্বাস ঘরের মালামাল ভাসিয়ে নিয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের পানি যখন তাদের ঘরের চৌকির ওপর উঠে পড়ে, তখন তিন বছরের শিশুটিকে তার মা বুকে আগলে রেখেছেন। ছোট্ট এ শিশুটিকে নিয়ে খুবই ভয়ংকর সময় পার করেছেন তারা।
ঘূর্ণিঝড়ের আগেই কোনো কোনো অভিভাবক ঘরে অবস্থান নিলেও নারী ও শিশুদের পাঠিয়ে দিয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। তাদের একজন জেলে আমির হোসেন। ঝড়ের পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ আকার ধারণ করে, তার আগেই স্ত্রী এবং চার বছরের শিশু জুনায়েদ হোসেনকে পাশের আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন তিনি।
আমির হোসেন জানান, ঘরের মালামাল হারানোর ভয়ে আমি ঘরে থেকে যাই, কিন্তু মালামাল তো দূরের কথা, ঘরটিও রক্ষা করতে পারিনি। জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর ও সদরের আংশিক এবং কমলনগর ও রামগতি উপজেলার মেঘনার উপকূলে কি পরিমাণ শিশুর বসবাস- এর সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা না থাকলেও স্থানীয়দের মতে কয়েক হাজার শিশু মেঘনার তীরে বসবাস করে। এসব শিশুরা মৌলিক অধিকার বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। পাশাপাশি বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বেড়ে উঠছে তারা।
ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন ও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে ৩২ লাখ শিশু।
স্থানীয় সাংবাদিক ও ইতিহাস লেখক সানা উল্লাহ সানু বলেন, ঝড়ের আগে-পরে মেঘনা পাড়ের শিশুদের মনে ব্যাপক ভয় ঢুকেছে। এ ঝড়ের দুর্বিষহ স্মৃতি তাদেরকে বারবার তাড়িয়ে বেড়াবে। অনাগত সব দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে উপকূলীয় শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
ঝড়ের পরে ত্রাণ ও পুনর্বাসনে শিশুদের কথা সবার আগে ভাবা উচিত বলে যোগ করেন তিনি।
এএইচ
আরও পড়ুন