ঢাকা, বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

দৃষ্টিভঙ্গি : নেপথ্যনায়ক

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৫৯, ৯ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৫:৩৯, ২০ জুলাই ২০২১

মস্তিষ্করূপী বিস্ময়কর জৈব কম্পিউটার যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্যে প্রয়োজন সুসংহত মানসিক প্রস্তুতি। আর মানসিক প্রস্তুতির ভিত্তি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়ত বা অভিপ্রায়। কারণ মন পরিচালিত হয় দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত দ্বারা। আর মস্তিষ্ককে চালায় মন। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণা করেছেন মন ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে। ড. অ্যালেন গোল্ডস্টেইন, ড. জন মটিল, ড. ওয়াইল্ডার পেনফিল্ড ও ড. ই রয় জন দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, একজন প্রোগ্রামার যেভাবে কম্পিউটারকে পরিচালিত করে, তেমনি মন মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে। মস্তিষ্ক হচ্ছে হার্ডওয়্যার আর মন হচ্ছে সফটওয়্যার। নতুন তথ্য ও নতুন বিশ্বাস মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করে। নতুন সিন্যাপসের মাধ্যমে তৈরি হয় সংযোগের নতুন রাস্তা। বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্মপ্রবাহের প্যাটার্ন। মস্তিষ্ক তখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নতুন বাস্তবতা উপহার দেয়। নতুন বাস্তবতা ভালো হবে না খারাপ হবে, কল্যাণকর হবে না ক্ষতিকর তা নির্ভর করে মস্তিষ্কে দেয়া তথ্য বা প্রোগ্রামের ভালো-মন্দের ওপর। কল্যাণকর তথ্য ও বিশ্বাস কল্যাণকর বাস্তবতা সৃষ্টি করে আর ক্ষতিকর তথ্য বা বিশ্বাস ক্ষতিকর বাস্তবতা উপহার দেয়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, জীবনের নতুন বাস্তবতার চাবিকাঠি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত।

বিজ্ঞানীরা বলেন দৃষ্টিভঙ্গি দুধরনের। এক. প্রো-অ্যাকটিভ। দুই. রি-অ্যাকটিভ। প্রো-অ্যাকটিভ অর্থ হচ্ছে যে-কোনো পরিস্থিতিতে উত্তেজিত বা আবেগপ্রবণ না হয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রো-অ্যাকটিভ অর্থ হচ্ছে অন্যের কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কোনো কাজ বা আচরণ না করা। সর্বাবস্থায় নিজের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আচরণ ও কর্মপন্থা অবলম্বন করা। প্রো-অ্যাকটিভ অর্থ হচ্ছে, কী কী নেই তা নিয়ে হা-হুতাশ না করে যা আছে তা নিয়েই সুপরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করা। প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় সাফল্য ও বিজয় ছিনিয়ে আনে।

অপরদিকে রি-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ব্যর্থতা, হতাশা ও অশান্তি সৃষ্টি করে। রি-অ্যাকটিভ হলে নিয়ন্ত্রণ তখন নিজের হাতে থাকে না। নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যের হাতে। আপনি যখন অন্যের কথায় কষ্ট পান, অন্যের কথায় রেগে যান, অন্যের আচরণে ক্রোধে ফেটে পড়েন, অন্যের তোষামোদিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, অন্যের চাটুকারিতায় গলে যান, অন্যের কথায় নাচেন, তখন নিয়ন্ত্রণ আর আপনার হাতে থাকে না। নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যের হাতে। রি-অ্যাকটিভ হলে, নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে চলে গেলে পরিণতি কী হয়, তা দুইটি অতি প্রচলিত গল্প থেকে আমরা অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারি।

বাবা, ছেলে ও গাধার গল্প
বাবা ও ছেলে বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ির পোষা গাধাটিকে বিক্রি করার জন্যে হাটের পথে যাত্রা শুরু করল। বাবা, ছেলে ও গাধা তিনজনই হেঁটে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর তাদেরকে দেখে একজন বলল, লোক দুটি কী বোকা! গাধা থাকতে হেঁটে যাচ্ছে। একজন তো গাধার পিঠে উঠে আরাম করে যেতে পারে। বাবা ছেলেকে গাধার পিঠে উঠিয়ে দিলেন। ছেলে গাধার পিঠে আর বাবা হেঁটে চলছেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আরেকজন বলল, কী বেয়াদব ছেলে! নিজে গাধার পিঠে আরাম করে যাচ্ছে আর বুড়ো বাপকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

এ মন্তব্য শোনার পর বাবা ও ছেলে স্থান পরিবর্তন করল। বাবা গাধার পিঠে আর ছেলে হেঁটে। আরো কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আরেক ব্যক্তি মন্তব্য করল, কী নিষ্ঠুর পিতা! নিজে গাধার পিঠে আরাম করছে আর মাসুম বাচ্চাটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ মন্তব্য শোনার পর বাবা ও ছেলে দুজনই গাধার পিঠে উঠল। গাধা চলতে শুরু করল। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর একজন পশু প্রেমিকের নজরে পড়ল তারা। পশু প্রেমিক তাদের দেখে আক্ষেপ করে বলতে শুরু করল, কী অত্যাচার! কী অবিচার! একটি গাধা তার ওপর দুটি লোক!

বাবা ও ছেলে পড়ল মহা সমস্যায়। কী মুশকিল! গাধার সাথে হেঁটে গেলে দোষ। ছেলে উঠলে দোষ! বাবা উঠলে দোষ! দুজন উঠলে দোষ! এখন কী করা যায়? বাবা-ছেলে দুজন মিলে এক নতুন বুদ্ধি বের করল। বাঁশ ও রশি জোগাড় করল। গাধার চার পা ভালো করে বাঁধল। তারপর পায়ের ফাঁক দিয়ে বাঁশ ঢুকিয়ে দিল। বাবা সামনে আর ছেলে পেছনে বাঁশ কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। গাধা রইল ঝুলে। 

গাধাকে কাঁধে নিয়ে পুল পার হওয়ার সময় গাধা ভয় পেয়ে চিৎকার করে নড়ে উঠল। বাবা, ছেলে ও গাধা পড়ে গেল খালে। গাধার মেরুদণ্ড ভাঙল। বাবা ও ছেলের ভাঙল পা। গাধা আর বেচা হলো না। বাবা ও ছেলে আহত অবস্থায় ফিরে এল ঘরে।

পণ্ডিত মশাই ও পাঁঠার গল্প
সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী পণ্ডিত মশাইয়ের ইচ্ছে হলো পাঁঠার মাংস খাবেন। পাঁজি পুঁথি দেখে দিনক্ষণ গণনা শেষে শুভ মুহূর্ত নিরূপণ করে যাত্রা করলেন হাটে। হাটে গিয়ে নাদুসনুদুস পাঁঠা পেয়ে গেলেন একটা। পণ্ডিত মশাই খাবেন তাই বিক্রেতা দামও একটু কমিয়ে রাখল। কম দামে নাদুসনুদুস পাঁঠা পেয়ে মনের আনন্দে পণ্ডিত মশাই পাঁঠাটিকে কাঁধে উঠিয়ে বাড়ির পথে ফিরছেন। পণ্ডিত মশাইয়ের কাঁধে নাদুসনুদুস পাঁঠা দেখে রাস্তায় প্রতারণার উদ্দেশ্যে অপেক্ষমাণ পাঁচ ঠগ মুহূর্তে বুদ্ধি স্থির করে ফেলল। বেশ খানিকটা দূরত্ব নিয়ে রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে লাগল। 

পণ্ডিত মশাই প্রথম ঠগের কাছাকাছি যেতেই ঠগ এগিয়ে এসে পণ্ডিত মশাইকে প্রণাম করে বলল, ঠাকুর! আপনার মতো সজ্জন ব্রাহ্মণ এই গ্রামে কেউ নেই। কিন্তু আপনার কাঁধে কুকুর কেন! পণ্ডিত মশাই রেগে গেলেন তার কথায়। বললেন, কুকুর কোথায়, এটা তো পাঁঠা।

প্রথম ঠগকে ফেলে পণ্ডিত মশাই এগিয়ে গেলেন। দ্বিতীয় ঠগের কাছে আসতেই সে এগিয়ে প্রণাম করে বলল, ঠাকুর! আপনার মতো সজ্জন ব্রাহ্মণ এই ইউনিয়নে নেই। কিন্তু আপনি কুকুর কাঁধে নিয়ে যাচ্ছেন কেন! 

পণ্ডিত মশাই তার প্রতিও আগের মতো বিরক্তি প্রকাশ করে এগিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তৃতীয় ঠগ এগিয়ে এসে পণ্ডিত মশাইকে প্রণাম করে বলল, ঠাকুর আপনার মতো ব্রাহ্মণ এই পুরো থানায় নেই। কিন্তু আপনার কাঁধে কুকুর কেন। পণ্ডিত মশাইর তখনো নিজের বিবেচনার ওপর আস্থা প্রবল। তিনি আগের মতোই বিরক্তি প্রকাশ করে এগিয়ে চললেন। 

এবার চতুর্থ ঠগ এগিয়ে এসে ভক্তি গদগদভাবে প্রণাম করে বলল, আপনার মতো ব্রাহ্মণ পুরো জেলায় নেই। কিন্তু ঠাকুর আপনার আজ কী হলো, অস্পৃশ্য কুকুরকে আপনি কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন? [সনাতন হিন্দু ধর্ম অনুসারে কুকুর এক নিকৃষ্ট প্রাণী। কোনো ব্রাহ্মণ এটি স্পর্শ করতে পারেন না।] 

পণ্ডিত মশাই এবার একটু ভাবলেন। আমি তো দেখে শুনে নাদুসনুদুস পাঁঠা কিনলাম। কিন্তু এর আগেও তিনজন এটাকে বলছে কুকুর। এ-ও বলল কুকুর। ঠিক আছে একটু কাঁধ থেকে নামিয়ে দেখি। পণ্ডিত মশাই পাঁঠাটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে লেজ নেড়েচেড়ে ভালো করে দেখলেন। দেখে আবার নিশ্চিত হলেন এটি কুকুর নয় পাঁঠা। আবার পাঁঠাটিকে কাঁধে চড়ালেন। কিন্তু কাঁধে চড়ালে কী হবে-আসলে পণ্ডিত মশাইয়ের নিজের ওপর বিশ্বাসের ভিত তখন নড়বড়ে হয়ে গেছে। তা না হলে দেখেশুনে কেনা পাঁঠাকে আবার পরীক্ষা করতে যেতেন না। 

এরপর পঞ্চম ঠগ যখন প্রণাম শেষে বলল ঠাকুর! আপনার কাঁধে কেন কুকুর? তখন পণ্ডিত মশাইর নিজের ওপর বিশ্বাস পুরোটাই ভেস্তে গেল। জলজ্যান্ত পাঁঠাটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে জোরে এক লাথি মারলেন। আক্ষেপ করে বললেন, কার মুখ দেখে যে আজ যাত্রা করেছিলাম! কিনলাম পাঁঠা হয়ে গেল কুকুর! আর ওদিকে পণ্ডিত মশাই দৃষ্টির আড়ালে যেতেই পাঁঠাটাকে ধরে মজা করে খাওয়ার জন্যে নিয়ে গেল ঠগেরা নিজেদের আস্তানায়।

রি-অ্যাকটিভ হওয়ার কারণে, অন্যের কথার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পদক্ষেপ নেয়ার ফলে বাবা ও ছেলে গাধাকে বিক্রি করতে পারল না, নিজেরা আহত হলো। পণ্ডিত মশাইয়ের পাঁঠা ঠগেরা খেলো। 

আসলে আপনি যখন নিজস্ব বিচার বিবেচনার পরিবর্তে অন্যের উস্কানিতে বা অন্যের প্ররোচনায় বা অন্যের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বা উত্তেজিত হয়ে পদক্ষেপ নেন, তখন তা 'ক্রিয়া' নয়, তখন তা হয় 'প্রতিক্রিয়া'। আর 'প্রতিক্রিয়া' কখনো 'ক্রিয়া'র মতো ফলপ্রসূ হয় না। 'প্রতিক্রিয়া' সবসময় ব্যর্থতা ডেকে আনে।

প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজিত সিদ্ধান্ত কীভাবে ব্যর্থতা ডেকে আনে মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর প্রতিপক্ষরাই তার প্রমাণ। মোহাম্মদ আলী সবসময়ই দৈহিক দিক থেকে তার চেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছেন। মোহাম্মদ আলীর বক্সিং-এর কৌশল ছিল অভিনব। তিনি রিং-এ নেমেই লাফাতে শুরু করতেন, হাত চালানোর চেয়ে লাফাতেন বেশি। আর সেইসাথে শুরু করতেন প্রতিপক্ষকে বকাবকি, গালিগালাজ। 

তার গালিগালাজে প্রতিপক্ষ বেশিরভাগ সময়ই প্রবলভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠত এবং এক ঘুষিতে নক আউট করার জন্যে প্রবল বেগে ঘুষি মারত। আর মোহাম্মদ আলী সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেন পুরোপুরি। বিদ্যুৎ গতিতে একটু সরে গিয়েই লেফট হুক বসিয়ে দিতেন। ভারসাম্যহীন প্রতিপক্ষ ধরাশায়ী হয়ে যেত সহজে। (কারণ প্রবল বেগে কোথাও আঘাত করতে চাইলে, আঘাত সেখানে না লাগলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়)। 

আসলে রি-অ্যাকটিভ হয়ে, উত্তেজিত হয়ে, রেগে গিয়ে কিছু করলে সাধারণভাবে পরাজয়ই কপালে জোটে।
লেখাটি কোয়ান্টাম মেথডের প্রবক্তা মহাজাতক এর মেডিটেশন বই থেকে সংগ্রহ।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি