দেশে নীতির অভাব নেই, আছে বাস্তবায়নের : কাজী খলীকুজ্জমান
প্রকাশিত : ২২:১৫, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১০:৫৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, দেশে আইন বা নীতির কোন অভাব নেই। আছে শুধু বাস্তবায়নের। আত্মতুষ্টি ও গাফিলতির কারণে এসব বাস্তবায়ন আটকে যায়। শুক্রবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে (আইডিইবি) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ‘শিল্প সংক্রান্ত বিষয়াবলী’ শীর্ষক সেশনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনদিন ব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৮টি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশ বরেণ্য অর্থনীতি, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা অংশ নেয়।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, অনেক ক্ষেত্রে খুব ভালো আইন আছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এগুলো সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর দেখা সম্ভব না। প্রধানমন্ত্রী যে সব নির্দেশ দেন তার সবগুলোই ভালো। কিন্তু এগুলো যারা বাস্তবায়ন করবেন তারাই কাজ করেন না। তিনি বলেন, দেশে খুব বড়-ভালো বাজেট করা হয়। প্রথম ৪ মাসে মাত্র ১০ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হয়। অথচ শেষ এক-দু’ মাসে সব বাস্তবায়ন হয়ে যায়। প্রথম দিকে কাজ না হওয়া যেমন সমস্যা তেমনি শেষ দিকে বেশি বাস্তবায়ন হওয়া আরো বড় সমস্যা। কাজ না হলেও সব টাকা চলে যায়। এক্ষেত্রে যারা বাজেট বাস্তবায়ন করেন তাদের চরিত্র ঠিক করা উচিত।
নীতি-নির্ধারকদের আত্মতুষ্টি আর বাস্তবায়নকারীদের গাফিলতি সমাজ ও অর্থনীতিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নীতি-নির্ধারকদের বলা হয় সবকিছু ভালো চলছে। অনেক কাজ করা হয়েছে। আর কিছু করা দরকার নেই। এ কথা শুনে তারা আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। আর যারা বাস্তবায়নকারী তারা কাজ বুঝিয়ে দেয়ার পর গাফিলতি শুরু করেন। এ আত্মতুষ্টি ও গাফিলতি সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বত্র বিদ্যমান।
সুনামগঞ্জ হাওরে আগাম বন্যার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছরই হাওরে বন্যা হয় এবং বাঁধ ভাঙে। এবার একটু আগাম হয়েছে। যে বাঁধ দেয়া হয় সেটা প্রতিবছর বন্যার সময় পানি নীচে ডুবে যায় এবং ভেঙে যায়। কিন্তু তার আগেই ফসল কাটা হয়। বাঁধ নির্মাণের জন্য বন্যাকালীন সময়ের একমাস আগে কমিটি করা হয়। এবার সেটি করা হয়নি। এটাই নৈতিকতার স্থলন। যার কমিটি করার কথা তিনি কমিটি করেননি, অর্থাৎ গাফিলতি করেছেন। আর ওপরে যারা আছেন তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, কোন সমস্যা নেই। সুতরাং তারা আত্মতুষ্টি নিয়ে আছেন। এ আত্মতুষ্টি ও গালিফলি সমাজ-অর্থনীতিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসডিজি নিয়ে বিভিন্ন সেমিনারে আলোচনায় অর্থনীতিবিদ-মন্ত্রীরা বলেন, এটা করতে হবে-ওটা করতে হবে। এসব তো এসডিজিতে বলাই আছে। মন্ত্রীদের বলা উচিত, এটা করেছি-ওটা করেছি। আর অর্থনীতিবিদদের বলা উচিত, লক্ষ্য অর্জনে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে।
এর আগে দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সকালে ৪টি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর বিষয়বস্তু ছিল ‘ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত’, ‘বিশেষ প্রায়োগিক ক্ষেত্রসমূহ’, ‘দারিদ্র্য ও অসমতার সমস্যাসমূহ’ এবং ‘মানব মূলধন সংক্রান্ত’।
‘বাংলাদেশের সংবিধান ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ: কিছু নৈতিক প্রশ্ন’ প্রবন্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন খান বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারকে দিন বদলের সনদ আখ্যা দিয়েছিল। দিন বদল পুরোপুরি যেতে অনেক দূর যেতে হবে। টেকসইভাবে দারিদ্র্য উচ্ছেদ, একমুখী শিক্ষা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, দুর্নীতি রোধ, দখল-জবরদখলের মতো বিষয়গুলো সুরাহা হয়নি। আমলাতন্ত্রের সমস্যা তো আছেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা অবশ্যই আমলাতন্ত্র।
‘শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্পোরেট সংস্কৃতি: টেকসই উন্নয়নে এ যেন এক অশনি সংকেত’ শীর্ষক প্রবন্ধে সিলেট ক্যাডেট কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ জসীম উদ্দীন বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন করপোরেট সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষার সকল স্তরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান করপোরেট আদলে পরিচালিত হচ্ছে। যা অনাকাঙ্খিত। আর কতিপয় মুনাফালোভী ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তির লাভের পথ সুগম হচ্ছে। দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে এ সুবিধা নিতে দেয়া যাবে না।
জসীম উদদীন বলেন, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত মুনাফালোভী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার ব্যঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। কেউ দেখছে না। কেউ কিছু বলছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সংস্কৃতি পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
দারিদ্র্য ও অসমতার সমস্যাসমূহ সেশনের সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির সম্মানীত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত মানুষের প্রয়োজন পরিবর্তন হচ্ছে। ১৯৭০ সালে শিক্ষা মূল প্রয়োজনের মধ্যে ছিল না। কিন্তু এখন সবাই শিক্ষাগ্রহণ করছে। তেমনি ২০৩০ সালে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়তে হলে দারিদ্র্যের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই ক্ষুধামুক্ত বলতে কী শুধু পেট ভরে খাওয়াকে বোঝানো হবে নাকি পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার থাকবে। তিনি আরো বলেন, মাথাপিছু আয় বাড়ানোর চাইতে সম্পদের বন্টন বাড়াতে হবে।
‘সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন’ শিরোনামের আরেক প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের জোসেফ করবেল স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক হায়দার আলী খান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে রেফারেন্ডাম বা গণভোটের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নারী, সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে এ গণভোট থাকতে পারে। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্রকে গভীরতম করতে হলে বেশ কিছু অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক শর্তের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাঁর মতে, মতপার্থক্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অবস্থানে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দল ও মতকে প্রকাশ করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পাড়া মহল্লা থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গণতন্ত্রের গভীরায়নের সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তিনি বলেন, অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে; ধর্মঘট হবে অহিংস বিক্ষোভ হবে। এসব প্রদর্শনে জনগণের জন্য পথ খোলা রাখতে হবে।
ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত সেশনে ‘অর্থনীতি ও নৈতিকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর উপস্থাপনের কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তবে তার লিখিত প্রবন্ধে বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। যার ফলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সরকারগুলো আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না। এতে করে মানুষ সংকিত ও সংশয়ে আছে। কারণ, বারবার সরকার বদল করেও তাদের দুর্ভোগ কমছে না বরং বাড়ছে।
এই ব্যবসায়ীর মতে, দেশে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হলো সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে মিন্টু বলেন, উভয় দলে রয়েছে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় রাজনৈতিক অপরাধীদের চক্র। আর এই অপরাধ চক্রের বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যন্ত। অনৈতিক রাজনীতিই দুর্নীতির মূল উৎস।
আগামীকাল শনিবার সম্মেলনের সমাপনী দিনে ৬টি সেশন অনুষ্ঠিত হবে। এগুলোতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা অংশ নেবেন ।
আরকে//
আরও পড়ুন