ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

দেশের কাজের প্রতি নত না হলে উন্নত হওয়া যায় না

সিস্টার শিখা লেটিসিয়া গমেজ

প্রকাশিত : ১৫:০২, ১২ নভেম্বর ২০২৩ | আপডেট: ১৫:৪৫, ১২ নভেম্বর ২০২৩

জন্মমুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমার সময় নির্ধারিত। আর এ নির্দিষ্ট সময়ে আমি যে কাজ করি সেটাই জীবন। অর্থাৎ সময় এবং কর্মের সমষ্টিই জীবন। অন্যের কল্যাণে কাজের মধ্যেই মানুষের মহত্ব, মানুষের পরিচয়। কাজ তখনই অর্থবহ হবে যখন কাজের সাথে প্রেম যুক্ত হবে। আমার যা করণীয়, সেই কর্তব্যের প্রতি যদি বিশ্বস্ত থাকি, সেই কাজটাই যদি সবচেয়ে সুন্দরভাবে করি সেটাই আসলে দেশপ্রেম।

আমার প্রিয় গানের একটি অংশ হলো—ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকায় মাথা। এর মানে শুধু দেশকে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করা নয়, বরং দেশের মাটি ও মানুষের জন্যে মাথা নত করা। তাদের প্রয়োজনে ও তাদের কল্যাণে ভালবাসার সাথে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা। দেশের প্রতি কাজের প্রতি নত না হলে উন্নত হওয়া যায় না।  

একবার কলকাতায় কংগ্রেসের একটি বড় সমাবেশে মহাত্মা গান্ধী উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মানুষের তুলনায় টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের কারণে সবাই কষ্ট পাচ্ছিল এবং একে অন্যকে দোষারোপ করছিল। এ অবস্থা দেখে মহাত্মা গান্ধী নিজে দোকানে গিয়ে ঝাড়ু-বেলচা কিনে আনলেন এবং টয়লেট পরিষ্কার করার কাজ নিজেই শুরু করলেন। অথচ তখন তিনি বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। এটাই দেশপ্রেম—প্রয়োজনের সময় দেশের মানুষের উপকারে ছোট-বড় যে-কোনো কাজ নির্দ্বিধায় করতে পারা।

আরেকবার মাদার তেরেসা রেলগাড়িতে যাওয়ার পথে বার বার টয়লেটে যাচ্ছিলেন। এটা দেখে একজন জানতে চাইল তিনি অসুস্থ বোধ করছেন কিনা। মাদার তেরেসা বললেন, শরীর ভালো, কিন্তু এখন যেহেতু বসে আছি, এই সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছি। বার বার টয়লেটে গিয়ে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে দিচ্ছি, যাতে অন্য যাত্রীরা পরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবহার করতে পারে।

এভাবে দেশের জন্যে প্রতিমুহূর্তে ভাবা এবং দেশের প্রতিটি অংশকে সুন্দর করে তোলার জন্যে কাজ করা—এই নাগরিক দায়িত্ববোধটা জাগ্রত করতে হবে সবার মাঝে। অর্থাৎ যে-কোনো কিছু অন্যের ব্যবহার উপযোগী রাখা, অপরের কল্যাণের কথা চিন্তা করে কাজ করা—এটাই দেশপ্রেম।

 আমাদের সবার মধ্যে আছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। এই আত্মশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উজ্জ্বল রাখাটাই এ সময়কার দেশপ্রেম। এখন তো আর দেশের জন্যে অস্ত্র ধারণের প্রয়োজন নেই, কিন্তু যার যার অবস্থান থেকে যা করা প্রয়োজন সেটা করলেই জাতির জন্যে কিছু করা হলো। নিজের সেই কাজটা দায়সারাভাবে নয়, ভালোভাবে করার মনোভঙ্গি রাখতে হবে। প্রতিটি কাজে পবিত্রতা থাকতে হবে। কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দেশের প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা থাকতে হবে।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সৃষ্টির অধিকার’ রচনায় বলেছেন সৃষ্টিকর্তা ময়ূরকে নানা বিচিত্র রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন; মানুষকে দেন নি, তার ভিতরে রঙের একটি বাটি দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাকে তোমার নিজের রঙে সাজতে হবে’। তিনি বলেছেন, ‘তোমার মধ্যে সবই দিলুম, কিন্তু তোমাকে সেই-সব উপকরণ দিয়ে নিজেকে কঠিন করে সুন্দর করে আশ্চর্য করে তৈরি করে তুলতে হবে, আমি তোমাকে তৈরি করে দেব না’। আমরা তা না করে যদি যেমন জন্মাই তেমনিই মরি, তবে তাঁর এই লীলা কি ব্যর্থ হবে না।

মহৎ কর্মের মধ্য দিয়েই মানুষকে রঙিন হতে হয়। আজকের দিনটিই, এই মুহূর্তটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অপচয় করার মতো সময় আমাদের কারো হাতে নেই। আমরা একটা চর্চা শুরু করতে পারি। তা হলো, প্রতিদিন অন্তত একটি ভালো কাজ করে তা লিখে রাখব। সেটা স্মরণ করতে করতে ঘুমাব এবং সকালে ঘুম থেকে জেগে নতুন একটি ভালো কাজের পরিকল্পনা করব। বার বার স্মরণ করতে হবে—আমার কাজ আমার শক্তি আমার মেধা আমার দক্ষতা সবই মানুষের জন্যে। এটাই দেশপ্রেম।

[হলিক্রস কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা লেটিসিয়া গমেজের ‘আমার কাজই আমার দেশপ্রেম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান দেয়া বক্তব্য থেকে নেয়া। তিনি ১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি গাজীপুরের তেঁতুইবাড়ি গ্রামে তার জন্ম। ১৯৮৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৯৩ সালে বাংলায় এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে তিনি অর্জন করেন প্রথম স্থান। এরপর ব্যাঙ্গালুরুর ধর্মরাম কলেজ থেকে ধর্মতত্ত্বে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন ১৯৯৬ সালে। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ২০০৬ সালে প্রথম স্থান অর্জন করে এমএড ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

ঈর্ষণীয় শিক্ষা সাফল্যের পাশাপাশি শিখা লেটিসিয়া গমেজের জীবনে দেখা মেলে সত্য, মানবিকতা ও সেবার দর্শন। পিসিমা বেনেডিক্টা গমেজের জীবনাদর্শ দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে একসময় খুঁজে পান নিজের জীবনের লক্ষ্য। অতঃপর মানব কল্যাণে নিজের মেধা শ্রম ও সময়কে সঁপে দেন তিনি। ১৯৮৭ সালে যোগ দেন হলি ক্রস ধর্মসংঘে। দুদশকের বেশি সময় ধরে তিনি এ সঙ্ঘের গুরুত্বপূর্ণ বহু দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ ক্যাথলিকমণ্ডলী ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবেও তিনি রেখে চলেছেন দক্ষতা ও সুগভীর চিন্তার ছাপ। জাতীয় পর্যায়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্যে কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজেও তিনি যুক্ত।

হলি ক্রস কলেজে সিস্টার শিখা শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৯৮ সালে। নবীনপ্রাণ শিক্ষার্থীদের জীবনে ভালবাসা, বিশ্বাস আর আশার সঞ্চার এবং তাদেরকে আত্মপরিচয়ে বলীয়ান করাই তার জীবনব্রত। এ মমতাময়ী শিক্ষক বিশ্বাস করেন—শ্রেণিকক্ষই তার উপাসনালয়। তাই-তো তার সান্নিধ্যে আসা শিক্ষার্থীদের প্রিয় নাম ‘সিস্টার শিখা’। ২০১০ সালে তার ওপর এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। মেধাবী, প্রত্যয়ী ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে সিস্টার শিখার প্রয়াস সত্যিই প্রেরণাদায়ক।]

এএইচ


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি