ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ধর্ম ও জীবন কি আলাদা?

প্রকাশিত : ১৪:২১, ১২ জুলাই ২০১৯ | আপডেট: ১৭:০১, ১৫ জুলাই ২০১৯

আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষই ধর্মকে জীবন থেকে আলাদা করে দেখে। এদের কাছে চলমান জীবনই হচ্ছে একমাত্র বাস্তবতা। সে বাস্তবতার সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগাযোগ নেই। এরা ধর্মকে সযত্নে জায়নামাজে রেখে দিয়েছেন।

জীবন থেকে ছুটি নিয়ে মাঝে মাঝে এরা ধর্মকে ছুঁয়ে আসেন। সেটা হোক না পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। ওয়াক্ত শেষ হলেই এরা জীবনে ফিরে আসে-জীবনের নির্ধারিত পথে এবং ছন্দে চলে। এদের রোজা এবং হজও  একই রকম।

এগুলো তাদের কাছে জীবন থেকে এক ধরনের সাময়িক ছুটি নেওয়া-ওই যেমন করে অফিস থেকে কারণে অকারণে ছুটি নেওয়া। কিন্তু কোরআনে যে নামাজের কথা বলা হচ্ছে তার নাম কিন্তু সালাত। নামাজ আর সালাত কিন্তু এক জিনিস নয়। নামাজ পড়, কিন্তু সালাত পড়ার জিনিস নয়-কোরআন বলছে এটা কায়েম করার জিনিস।

একথা আমিও যে ভাল বুঝি এমন দাবি করি না। কিন্তু সে কথা পরে বলছি। আগে ওই অনুষ্ঠান সর্বস্ব মানুষগুলোর ধর্মকর্ম সম্পর্কে কিছু বলে নেই।

সুরা বাকারার ১৭৭ নাং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ পূর্ব ও পশ্চিমদিকে মুখ ফিরানোতে কোনো পূণ্য নাই; কিন্তু তোমাদের পূণ্য আছে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, সমস্ত কিতাব এবং নবীতে বিশ্বাস করলে এবং আল্লাহর প্রেমে আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থী এবং দাস মুক্তির জন্য অর্থদান করলে, সালাত কায়েম করলে যাকাত দিলে এবং অঙ্গীকার রক্ষা করলে এবং অর্থসংকটে দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রামে সংকটে ধৈর্যধারণ করলে। এরাই হচ্ছেন সত্যনিষ্ঠ এবং এরাই হচ্ছেন মুত্তাকী।’

এ থেকেই নিশ্চিয়ই বুঝতে পারছেন ইসলামে ধার্মিকতা বলতে কি বুঝায় এবং পূণ্যের সংজ্ঞা কি। একটা যান্ত্রিক নিয়মে পূর্ব বা পশ্চিমে সেজদা করার মধ্যে কোনো পূণ্য নাই-কোনো সওয়াব নাই।

আসলে সওয়াব বলতে কি বুঝায় তা আমরা জানি না। যখন সত্তর বা সত্তর হাজার সওয়াবের কথা বল হয় তখন আমার সত্যি হাসি পায়।

সওয়াব কি বাজারের সওদা যে ওটা গোনা যায়? নামাজ পড়ার জিনিস নয়। মানুষের জীবনটাই একটা প্রলম্বিত নামাজ বা সালাত। এ সালাত থেকে কোনো ছুটি নেই। অবসর নেই। যারা শুধু জাহেরি বা প্রকাশ্য সেজদা করে তাদের জন্য ছুটি আছে, অবশ্যই আছে। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে অবসর বিনোদনের জন্য যেমন বেড়াতে যাও যায় তেমনি।

কিন্তু এ ছুটি আমরা নিচ্ছি নাফ্সের তাড়নায়।  যখনই জীবন নামক সালাত থেকে আমরা  ছুটি নিচ্ছি তখনই আমরা দাসত্ব করছি নফ্সের তাড়নায়, কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্খা এবং লোভ-লালসার। ওটাই শিরক।

শিরক মানে তো কেবল মুখে আল্লাহর সাথে অন্যকে অংশীদার করা নয়। শিরকমুক্ত জীবন মানে আল্লাহতে নিবেদিত জীবন। জীবন যখনই সে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে নারীর দিকে, অর্থের দিকে, ক্ষমতার দিকে কিংবা অন্য কোনো পার্থিব জিনিসের দিকে ধাবিত হলো তখনই তা শিরক করা হলো। সালাত যার জন্য নিবেদিত সেই মহাপ্রভুর দাসত্বকে অস্বীকার করলে।

আল্লাহর কাছে আমানু বা বিশ্বাসী তারাই যারা এই জীবনের অন্তরে নিহিত সালাতকে গ্রহণ করেছে। সালাত তাদের কাছে শুধু মাথা ঝোঁকানো তা নয়। এদের কাছে জীবনের প্রতিটি সৎ কাজই সালাত আর সৎকাজ হচ্ছে তাই যা মানুষ আল্লাহর জন্যে করে-আল্লাহকে স্বরণে রেখে করে। যে আয়াতটি আমরা উল্লেখ করেছি তার মধ্যে তিনটি স্তর আছে।

প্রথমত, রয়েছে এমন একটা স্তর যা অন্তর্জীবনকে আলোকিত করবে। আল্লাহতে বিশ্বাস, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাব এবং সমস্ত নবীতে বিশ্বাস। এই স্তরটি যার নেই তার জীবন মানুষের জীবন নয়।  এ বিশ্বাস যার নেই তার সঙ্গে পশুর জৈবিক অস্তিত্বের বিশেষ কোন তফাত নেই। কারণ এ বিশ্বাস না থাকলে নিজেকেই অস্বীকার করা হবে।

দ্বিতীয়ত, রয়েছে প্রাত্যহিক জীবন যে জীবন যাপিত হবে কেবল নিজের জন্য নয়। সে জীবন অন্য জীবনকে হাত ধরে টেনে তুলবে দীন-দুঃখী, প্রতিবেশী, দুঃস্থ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে সে জানবে এ সবই  এক মহাজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ।

সে নিজেও সেই মাহজীবনের এ বিশেষ লগ্নের পথিক। অন্য পথিকের হাত ধরে প্রকৃতপক্ষে সে নিজেরাই  হাত ধরবে। আর তৃতীয়ত রয়েছে এক প্রতীক্ষার স্তর। তার অন্তর্জীবনের ওই বিশ্বাস এবং তার জীবনচর্যা  যদি একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায় তাহলে পার্থিব জীবনের এই সুথ-দুঃখের ঢেউ তাকে না দেবে উল্লাস, না করবে হতোদ্যম।

জীবন যেখানে সমর্পিত তার সুখ-দুঃখও সেখানেই উৎসর্গিত। তাই ধার্মিকের আর একটি মহৎ গুণ হচ্ছে তার ধৈর্য বা সবর। আয়াতটিকে এ তিনটি স্তরবিশিষ্ট জীবনকেই বলা হয়েছে সত্যের জীবন এরাই হচ্ছেন মুত্তাকী।

এদের সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, -এরাই হচ্ছেন আল্লাহর বন্ধু এবং এদের না আছে কোন ভয়ভীতি না এরা কোন সংকটে উদ্বিগ্ন হন। জীবন হচ্ছে এমন একটা সালাত, জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যার কোন ইতি নেই। পশুর জন্য এ সালাত নির্দিষ্ট করা হয়নি, করা হয়েছে মানুষের জন্য।

পশুর জীবন নির্ভাবনায় কাটে, মানুষের জীবনই সংকটময়। কোন জীবন আমরা কামণা করি, সেটা একান্তই স্বাধীন ইচ্ছার ব্যাপার। আল্লাহ সে স্বাধীনতা দিয়েছেন। মহাপ্রভুর অনুগত্য স্বীকার করে অনন্ত জীবনের অংশ হবে, নাকি আত্মনির্মিত কারাগারে বন্দি হয়ে নিজেকে স্বাধীন ভাববে, এটা একান্তই নিজের ইচ্ছার ব্যাপার। তবে যদি আনুগত্য স্বীকার কর তাহলে সে জীবন হবে একটি নিরবচ্ছিন্ন সালাত-এমন একটা মধুর সঙ্গীত যার কোনো অন্ত নেই। 

[লেখাটি, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ লিখিত ‘হযরত সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌনপুরির (রহ) সঙ্গে ধর্ম দর্শনকেন্দ্রিক কথোপকথন তথা সংলাপ সমগ্‘ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।] 

 

  


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি