ধানভিত্তিক কৃষি এবং কিছু চ্যালেঞ্জ
প্রকাশিত : ২৩:২৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
দেশে এখন ভাতের অভাব নেই। এ কথা আমরা আজ জোর গলায় বলতে পারি। শুধু কি ভাত! ভাতের সঙ্গে আনুষঙ্গিক যা কিছু যেমন—তরিতরকারি, মাছ-মাংস, ফলমূল কোনো কিছুরই অভাব আছে বলে মনে হয় না। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে। অন্য কিছু নয়, প্রধান ফসল চাল উৎপাদনের একটা হিসাব যদি দেখি। ১৯৯১-৯২ থেকে ১৯৯৫-৯৬ পর্যন্ত চালের মোট গড় উৎপাদন ছিল ১৮.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তখন ছিল বিএনপির আমল। আওয়ামী লীগের পরবর্তী পাঁচ বছরে (১৯৯০-৯৭ থেকে ২০০০-০১ পর্যন্ত) এই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২৬.০১ মিলিয়ন মেট্রিক টনে। যা ৭.৩১ মিলিয়ন মেট্রিক টন বেশি। এরপর আবার ক্ষমতার পালাবদল। বিএনপি আসে ক্ষমতায়। ২০০১-০২ থেকে ২০০৫-০৬ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে চালের মোট গড় উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ০.০৬ মেট্রিক টন। অর্থাৎ বাড়েনি। এরপর আবার আওয়ামী লীগের পালা। ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত দুই টার্ম। এ সময়ে গড় মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৩৪.১৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এবারে আট মিলিয়ন মেট্রিক টন বেশি। যদি আলাদা করে এবারের উৎপাদন দেখা হয়, তবে এর পরিমাণ ৩৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। পরিমাণটা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় দুই মিলিয়ন মেট্রিক টন বেশি। এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের সময়ে ধানের ফলন বেড়েছে। দেশ চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। আমার বিশ্বাস ধান ছাড়া অন্যান্য কৃষিপণ্যের বেলায়ও একই চিত্র দেখা যাবে। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর যথাযথ দিকনির্দেশনার কারণে। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতি করেছেন বলে শুনেছি। আর সেখান থেকেই প্রাত্যহিক কৃষির ভালো-মন্দ তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এ কারণেই তিনি সারের সুষম ব্যবহারের গুরুত্বটা বুঝতে পেরেছিলেন সময়মতো। যে জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করে নন-ইউরিয়া সারের দাম চাষিদের সামর্থ্যের মধ্যে নিয়ে আসেন। পাশাপাশি ধান ছাড়াও অন্যান্য ফসলের দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল। কৃষি যান্ত্রিকায়নের বিষয়টি তিনি খেয়াল করেছিলেন।
আওয়ামী লীগের আবার যাত্রা শুরু ২০১৯ সালের প্রথম দিন থেকে; ভিশন ২০২১ মাথায় রেখে। সামনে ২০৪১-এ উন্নত বিশ্বের হাতছানি। এর মাঝে ২০৩০-এ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলে পৌঁছাতে হবে। আর দূরের লক্ষ্য হলো ডেল্টা প্ল্যান। অতএব আমাদের কৃষির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। ধান আমাদের প্রধান ফসল। তাই ধান নিয়ে কিভাবে আমরা এগিয়ে যেতে পারি! এই সরকার ২০২৫ পর্যন্ত থাকবে। এখন আমাদের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটির মতো। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা হবে ১৮ কোটির কাছাকাছি। আমাদের হিসাব অনুসারে ২০২৫ সাল নাগাদ এখন থেকে আর মাত্র তিন মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল বেশি উৎপাদন করতে পারলেই হয়। কিন্তু সেটা কতখানি সম্ভব হবে? বিশেষত যেখানে আমাদের যথেষ্ট ফসলের জমি নেই। আবহাওয়া ক্রমান্বয়ে বৈরী হয়ে উঠছে। মাটি দুর্বল হয়ে গেছে। পরিবেশদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে। কৃষি বাজারে সুস্থিরতার অভাব। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ তো আছেই।
এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সহজ কথা নয়। তবে ব্রির কিছু পরামর্শ আছে। প্রথমেই আসে ফলন পার্থক্যের বিষয়। একটি জাতের ফলন দেওয়ার প্রকৃত সামর্থ্য থেকে চাষির মাঠের প্রকৃত ফলনের মধ্যে বেশ ফারাক। গড়ে প্রায় এক টনের কাছাকাছি। এই ফলন-ফারাক কমিয়ে আনা একটা চ্যালেঞ্জ। চাষির বুদ্ধি-বিবেক, তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সার বা আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদির সহজপ্রাপ্যতা, কৃষিঋণ, স্থান-কাল-পাত্রভেদে উপযুক্ত জাত নির্বাচন এবং কৃষিবিষয়ক পরামর্শ এমনকি যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা—এ সবই ভালো ফলনের জন্য জরুরি।
জাত নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু বলার আছে। কৃষক থেকে শুরু করে বীজ ব্যবসায়ী এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসিও শুধু বাজারে কাটতির কথা মাথায় রেখে বীজ উৎপাদন করে থাকে। ফলে কয়েকটি মাত্র জাত নিয়েই চাষিদের চিন্তাভাবনা। এ জাতগুলো এরই মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বছর মাঠে থাকায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। তবুও চাষিরা এগুলো ছাড়তে চান না। এর প্রধান কারণ তাঁরা হালফিল উদ্ভাবিত জাতগুলোর বীজ হাতের কাছে পান না। এ জন্য এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত যেন উদ্ভাবনের পরপরই কোনো জাত চাষির কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় এবং জাতটি কোনোক্রমেই যেন পাঁচ বছরের বেশি মাঠে না থাকে। তাহলে ফলন পার্থক্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। কারণ নতুন জাত সব সময় ফলন বেশি দেয়।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো—মাটির উর্বরতা শক্তি ফিরিয়ে আনা। আমরা জানি আমাদের ফসলের জমির কোনো বিশ্রাম নেই। ফলে মাটি দুর্বল হয়ে গেছে। এ জন্য দরকার মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কিভাবে বাড়ানো যায় সে চিন্তা করা। ব্রিসহ বাংলাদেশের প্রতিটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু প্রযুক্তি আছে, যা দিয়ে মাটির জৈব পদার্থ বাড়ানো সম্ভব। যেমন ব্রি বলছে, কিছুটা খড় রেখে যদি ধান কাটা যায় তাহলে মাটির জৈব পদার্থ যেমন বাড়ে তেমনি পরবর্তী ফসলের জন্য বেশ খানেকটা সার সাশ্রয় করা যায়। আরেকটি বিষয় হলো বৈরী পরিবেশ। যেমন—খরা, বন্যা ও লবণাক্ত এলাকায় কিভাবে ধান জন্মানো যায়। এ জন্য ব্রি বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভাবিত জাতগুলো সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর যেহেতু এ ধরনের পরিবেশে ফসলের আবাদ করতে গিয়ে চাষিদের যথেষ্ট ঝুঁকির মোকাবেলা করতে হয়। তাই সরকারের উচিত চাষিদের পরিবেশ বুঝে ফসল-বীমার আওতায় নিয়ে আসা।
সুখের কথা, এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন কৃষিবিদ ও বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। আমার বিশ্বাস, কৃষি নিয়ে এই সরকারের প্রথম তিন টার্ম যতটা কঠিন ছিল; চলতি টার্ম তার চেয়েও কঠিন হবে। এ জন্যই একজন কৃষিবিজ্ঞানীকে কৃষির দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত সত্যি যুগান্তকারী। যদিও সারা বিশ্বে কৃষি মন্ত্রণালয় দেখভাল করার জন্য কৃষি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মন্ত্রী নিয়োগের উদাহরণ তেমন নেই। তবে যাঁরা নিয়োজিত হয়েছেন তাঁরা সার্থকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন। রুয়ান্ডার কৃষিমন্ত্রী মিস অ্যাগনেস মাটিলডা কালিবাটার কথা জানি। তিনি কৃষিবিজ্ঞানে পিএইচডিধারী। জাতীয় নীতিনির্ধারণে তিনি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকেন। তিনি তাঁর দেশে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিরও প্রবক্তা। নাইজেরিয়ার কৃষিমন্ত্রী ড. আকিনুওমি অ্যাডিসিনাও কৃষিবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রিধারী। আফ্রিকা এবং সারা পৃথিবীর কৃষি উন্নয়নে একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি পূজনীয়। বায়োফর্টিফায়েড ফসল উদ্ভাবনসংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ। তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ দেশে কৃষি উন্নয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছেন বলে জেনেছি। সদ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। আমাদের কৃষি ও কৃষি ব্যবস্থার নাড়ি-নক্ষত্র তাঁর জানা আছে। কারণ তিনি একসময় কৃষি গবেষণার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। সেই নিরিখেই আমি বলতে চাই, আমাদের কৃষিমন্ত্রীও একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতির কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবেন।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
ব্রি এবং ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট, ইরি।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।