ধ্যান স্রষ্টার রহস্যের চাবিকাঠি
প্রকাশিত : ২৩:১১, ১৯ মে ২০১৯
হযরত আদমের জন্ম স্বাভাবিক জৈবিক নিয়মে হয়নি। তাঁর সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর হুকুমে। অন্য দিকে হযরত হাওয়ার সৃষ্টিও জৈবিক নিয়মে হয়নি। তিনি বের হয়ে এসেছেন হযরত আদমের নফ্স থেকে। এঁরা পরম সুখে জান্নাতে বসবাস করছিলেন। শয়তানের প্ররোচনায় তাঁরা আল্লাহর হুকুম অমান্য করে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করলেন। ফলে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হলেন্ তারপর বহু বছরের অনুশোচনার পর তারা আল্লাহর রহমতের ছায়া আবার লাভ করলেন।
জৈবিক নিয়মে তাদের দু’জনের মিলনে মানুষের জন্ম হলো মাটির পৃথিবীতে। মানুষকে তার জন্মের দায়ভার বহন করতে হলো। আর সে দায়ভারের নাম হচ্ছে মনুষ্যকুলে জন্ম নিয়েও মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনা। মনে রাখতে হবে, আদম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সভ্যতা। সুরিয়ানী, হিব্রু, আররিসহ ভাষাতেই শব্দটি হচ্ছে ‘আদম’ এবং এর মানে হচ্ছে সভ্যতা। আদম সভ্যতার প্রতীক, কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় হযরত আদম যে কাজটি করলেন তা সভ্যতার পরিপন্থী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ। একটা জৈবিক প্রবৃত্তির দাসত্ব সরূপ। তাই সাধনার মাধ্যমে আবার সেই সভ্যতা অর্জন করতে হয়েছিলো। যে সভ্যতা ছিল একান্তভাবে স্রষ্টার দান। হযরত আদম যখন পৃথিবীতে এসেছিলেন তখন অন্যান্য মখলুক ছাড়া অন্য কোন মানুষ পৃথিবীতে ছিল না। তাই তার খেলাফত ছিল সমস্ত সৃষ্টির উপর-আল্লাহ হযরত আদমকে সমগ্র জমিনের উপর খলিফা করে পাঠিয়েছিলেন।
হযরত আদমকে আল্লাহ তিনটি এবাদাত শিখিয়েছিলেন-জিকির, মোরাক্বাবা এবং মোহাসাবা। এই তিনটি এবাদতই ছিল তার নামাজ। হযরত আদম আলেহা, আলেহা এই নামে আল্লাহকে ডাকতেন-এই ছিল তার নামাজ। আমাদের রাসূল (সা.) নবুয়ত পাওয়ার আগে বহু বছর হেরা গুহায় এভাবে জিকির করেছেন। এছাড়া হযরত আদম গর্দান ঝুঁকিয়ে মোরাক্বাবায় বসে থাকতেন, ধ্যানে নিমগ্ন হতেন যেমনটি করেছেন আমাদের হুজুর পাকের (সা:) নিজে।
মাওলানা আজাদ সুবহানির একটি বই আছে ‘বিপ্লবি নবী’ তাতে লেখক হেরার গুহায় হুজুর পাকের (সা:) এ সাধনার কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। মোরাক্বাবা হচ্ছে ধ্যানে সমগ্র সৃষ্টিকে ধারণ করা-অন্য কথায় স্রষ্টার সত্তার মাঝে বিলিন হয়ে যাওয়া। এজন্যই কোরআনে বারবার বলা হয়েছে, স্রষ্টার নিদর্শনসমূহের কথা এবং এদের উপর ধ্যান করা কথা। আসমান, জমিন, চন্দ্র, সূর্য, দিন-রাত-এ সবের মাঝেই আছে স্রষ্টার রহস্য। ধ্যান হচ্ছে এ রহস্যের চাবিকাঠি। সুরা সাবার ৪৬নং আয়াত লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই মোরাক্বাবার কথাই বলা হচ্ছে, ‘আমি তোমাদের একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি-দুই দুইজন কিংবা একজন করে দাঁড়াও, অতঃপর তোমরা চিন্তা করো।’
আর হযরত আদমের তৃতীয় সাধনা ছিল মোসাহাবা। রাতের গভীরে একাকী নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে নিজের বিচার করার নামই মোহাসাবা। তিরমিজি শরিফের একটি হাদিসে হুজুর বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি যে মৃত্যু আসার আগেই নিজেই বিচার করে নেয়।’
নামাজেই তো মোরাক্বাবা রয়েছে। হুজুর পাক (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যখন আল্লাহর এবাদাত করবে তখন হয় ভাববে তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ, না হলে ভাববে আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। আমাদের নামাজে এই মোরাক্বাবা নেই বলেই আমাদের নামাজ পরিপূর্ণতা লাভ করে না। তা না হলে অধীর আগ্রহে পিতা তো দাঁড়িয়ে আছেন দু’হাত বাড়িয়ে। সে বাহুতে ধরা দেবার আগ্রহ সন্তানের নেই। সন্তান একরাশ রঙিন প্রজাপতির পেছনে ধাবমান। রঙের নেশায় সে পিতার ব্যাকুল বাহুর কথা ভুলেই আছে। এ ভুল কি আমাদের ভাঙবে না?
সূত্র : হযরত সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌনপুরি’র (রহ) সংলাপ সমগ্র বই থেকে সংগৃহীত।
এমএস/ এসএইচ/