নতুন অর্থমন্ত্রী : আগামীর চ্যালেঞ্জ
প্রকাশিত : ২২:০৫, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯
অর্থনীতির উড্ডয়নের পথে বাংলাদেশ। সরকারের নানা উদ্যোগ, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ, ছোট, মাঝারি কিংবা বড় উদ্যোক্তাদের নিরলস শ্রম, নীতি নির্ধারণী মহলের সহযোগিতা এবং সর্বোপরি বিশ্ববাজারে এদেশীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এই উড্ডয়নের পথকে খানিকটা সহজ করেছে। গেলো এক দশকের প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, বাজেটের আকার, বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি কিংবা রাজস্ব আহরণের সূচকেও অর্থনীতির সামর্থ্য বা অন্তর্নিহিত শক্তি প্রমাণিত। তবে, এই সামর্থ্যের সবটুকু কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে আরো এগিয়ে নেয়াই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নতুন মন্ত্রিসভায় অসংখ্য চমকের মধ্যে অন্যতম অর্থমন্ত্রী। যিনি দীর্ঘদিন সামলেছেন আরেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সুতরাং, দেশের ভালো মন্দ, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কিংবা অতীত বাস্তবতা- সব ব্যাপারেই তিনি অবগত। তাই, অর্থমন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এবং অধীনস্ত কাজকর্মের জন্য তিনি নিশ্চই এগিয়ে থাকছেন। তবে, যেহেতু দুই মন্ত্রণালয়ে কর্মপরিধি, প্রক্রিয়া কিংবা ক্ষেত্র বেশ খানিকটা আলাদা; তাই তাকে কিছু বিষয় শুরু করতে হবে একেবারেই নতুনভাবে।
২০০৮ সাল থেকে গেলো দশ বছরে অর্থনীতির এগিয়ে চলার গল্প সবারই জানা। বর্তমান সরকার যখন সেই সময়ে দায়িত্ব নিলেন, তখন বিশ্বমন্দার কারণে বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন রপ্তানির সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা। কিন্তু, সৌভাগ্যবশত, মন্দার সেই আঁচ লাগেনি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে। যদিও, আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকা খাদ্য, সার এবং জ্বালানির দাম মারাত্মকভাবে ভুগিয়েছিল বাংলাদেশকে। সে রকম একটা পরিস্থিতিতে এই সরকার ক্ষমতা নিয়ে দারুণভাবে সামলেছে সবকিছু। যার, প্রমাণ, টানা দশ বছর ধরে পাওয়া সাড়ে ছয় শতাংশের ওপরে গড় প্রবৃদ্ধি। এছাড়া, কৃষির উৎপাদন, কাজের ক্ষেত্র, নতুন নতুন দেশি বিদেশি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি-রেমিট্যান্সও বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। আরো বড় কথা হলো, ২০০০ সালে জাতিসংঘে গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনা এমডিজি অর্জনেও বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। ১৫ বছরের এই পরিকল্পনার শেষ ছয় বছরই কাজ করেছে বর্তমান সরকার। যদিও, অর্থনীতির এই সাফল্যের মধ্যেও তৈরি হয়েছে বেশকিছু সঙ্কট। বিশেষকরে, ব্যাংক খাতে কুঋণ, পুঁজিবাজারের অস্থির আচরণ, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এবং ধনী গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি ইত্যাদি। তাই, এই সঙ্কটগুলো কাটিয়ে অর্থনীতির চলমান গতিকে ধরে রাখা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ানো বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
এক রকম উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অর্থনীতির ভালো অবস্থা নিয়ে গা ভাসানোর সুযোগ নেই একেবারেই। কারণ, এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটি বড় লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। যার অন্যতম, ২০২১ সালে মধ্য আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানো। এই অর্জনগুলো করতে এখনো পাড়ি দিতে হবে লম্বা পথ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হলেও, ঘাটতিও আছে বেশকিছু জায়গায়। তাই, সেগুলোতে ঠিকমতো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া দরকার।
তবে, লম্বা সময়ের পরিকল্পনার বাইরেও, তাৎক্ষণিক কিছু বিষয়ে অল্প সময়ের উদ্যোগে সমাধান করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। যা প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করার পাশাপাশি পূরণ করতে পারে বহুল প্রত্যাশিত চাহিদা বা গণআকাঙ্ক্ষাকেও।
এই মুহূর্তে অর্থমন্ত্রীর জন্য সে রকম অন্তত ৬টি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে; যেগুলোর স্বল্পমেয়াদে সমাধান খুবই জরুরি। এগুলো হলো, ১. রাজস্ব আয় বাড়ানো ২. নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন ৩. বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ৪. বড় প্রকল্প সময়মতো শেষ করা ৫. ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন এবং ৬. চলমান প্রবৃদ্ধির গতিকে ধরে রাখা। এই চ্যালেঞ্জগুলো বাস্তবায়নে খুব বেশি নতুন বিনিয়োগের দরকার নেই। দরকার হলো, সদিচ্ছা। কারণ, সমস্যাগুলো এক রকম চিহ্নিত।
রাজস্ব আয়ের কথা ধরা যাক। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এই খাত থেকে পূরণ হয়নি প্রত্যাশা। তারওপর এবারের লক্ষ্যমাত্রাও বেশ বড়; প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। যা অর্জনে যে উদ্যোগ, উদ্যোম এবং সংস্কার দরকার ছিল তা করা হয়নি। তাই, বছর শেষে বড় একটা ঘাটতির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এই ঘাটতি বড় হলে, বাজেটের টাকা কোথা থেকে আসবে- তা নিশ্চই চিন্তা করতে হবে। কেননা, কিছু কিছু বরাদ্দ বা খরচের খাত থেকে সরকারের পেছানোর সুযোগ নেই। আবার উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ কমালে, সেখানেও নতুন সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা থাকে। তাই, এমন অবস্থায় কি করে চাপ না বাড়িয়ে আয় বাড়ানো যায়, সে পথ খুঁজে বের করতে হবে।
২০১২ সালে ভ্যাট আইন করা হলেও, ছয় বছরে বাস্তবায়ন হয়নি নানা কারণে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, আসছে জুলাই থেকেই আইনটি কার্যকর করা হবে। কিন্তু, এখনো তা নিয়ে মতবিরোধ রয়ে গেছে সরকার এবং ব্যবসায়ী মহলে। এছাড়া, এই আইন কার্যকরের জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নও করা হয়নি খুব বেশি। এমনকি যারা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আইনটি কার্যকরে ভূমিকা রাখবেন- তারাও পাননি পর্যাপ্ত এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ।
গেলো কয়েক বছর ধরেই বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান নিয়ে কথা হচ্ছে ব্যাপক। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, বেসরকারি বিনিয়োগের নির্দিষ্ট গণ্ডিকে ছাড়াতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। অথচ, আগামী বছর শেষ হতে যাওয়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিনিয়োগের লক্ষ্য থেকে এখনো বেশ দূরে বাংলাদেশ। কেবল দেশি নয়, বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে রয়ে গেছে শঙ্কা। প্রতিযোগী দেশগুলোতে প্রতিবছর এই হার কম বেশি বাড়লেও, বাংলাদেশ দৌঁড়াতে পারছে না সেই গতিতে। যার কারণ হিসেবে উদ্যোক্তা দুষছেন আস্থার অভাব; রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদিকে। রয়েছে অবকাঠামো, আমলাতন্ত্রসহ নানা জটিলতা। যদিও, সরকারের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার চলমান উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে, এই সঙ্কট কাটবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিনিয়োগের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ইস্যুতেও আলোচনায় পুরো দেশ। এখনো, বছরে অন্তত ২০ লাখ কর্মক্ষম মুখ যুক্ত হচ্ছে বাজারে। কিন্তু, দেশের ভেতরে সব মিলিয়ে কাজের সুযোগ হচ্ছে ১২-১৫ লাখের। অনেকে দেশের বাইরে কাজের সুযোগ পেলেও, বড় একটা অংশ থেকে যাচ্ছে বেকার। যাদের মধ্যে আবার বড় একটা অংশ শিক্ষিত। পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত রিপোর্টই বলছে, শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে। তাই, কি কি উদ্যোগের মাধ্যমে এই সমস্যা কাটানো যায়, সেটা নিশ্চই সৃজনশীল উপায়ের মাধ্যমে বের করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে।
বর্তমানে দেশের ভেতরে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের ১০টি মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে সরকার। যেগুলোকে বিশেষ নজরদারির মাধ্যমে গতি আনতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে। পদ্মা সেতু, মাতারবাড়ি, পায়রা, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রো রেলসহ ওই প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতি পাবে নতুন গতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত যুক্ত হবে মূল অর্থনীতির সাথে। এরই মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের কাজও এগিয়েছে বেশ। কিন্তু, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে টাকা খরচের হিসাব আমলে নিলে দেখা যাচ্ছে, এখানেও গতি নেই প্রত্যাশিত মাত্রায়। কোনো কোনোটির গতি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির স্বাভাবিক বাস্তবায়নের হারের চেয়েও কম। তাই, প্রশ্ন আসবে- এতো বেশি নজর দিয়েই বা লাভ হচ্ছে না কেনো?
মনে রাখা দরকার, ওই দশটি প্রকল্পের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে বিদেশি ঋণের টাকায়। যা পরিশোধ করতে হবে, প্রকল্পগুলো থেকে পাওয়া সেবা বিক্রি করে। কিন্তু, যদি সময় মতো শেষ করা না যায়, তাহলে খরচ তো বাড়বেই। সেই সাথে, বাড়তি ঋণ পরিশোধের চাপ নিতে হবে অর্থনীতিকে। এই বিষয়ে শ্রীলঙ্কা কিংবা জিম্বাবুয়ের অভিজ্ঞতার কথা আমরা অনেকেই জানি। যারা ঋণের টাকার সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে না পারায় আটকে পড়েছিল ডেট ট্র্যাপে। যদিও, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা এখনো ভালো। তবে, প্রকল্পগুলো যাতে সঠিক সময়ে, গুণগতভাবে এবং নির্দিষ্ট খরচের মধ্যে শেষ করা যায় সে উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
আর্থিক খাত নিয়েও আলোচনা নতুন নয়। মন্দ ঋণের ভারে এক রকম জর্জরিত ব্যাংক খাত। নয়-ছয়ের সুদহারও কম ভুগায়নি ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের। তবে, দায়িত্ব নিয়েই অর্থমন্ত্রীর এ বিষয়ে উদ্যোগের ইঙ্গিত নিশ্চই প্রশংসনীয়। কিন্তু, সেটা কতোটা দ্রুত এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে সমাধান করা যায়- সেটাই দেখার বিষয়। এসব সংস্কারের বাইরে প্রবৃদ্ধির চলমান গতিকেও এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। আর এই প্রবৃদ্ধির সুবিধা সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষটি পাচ্ছে কি না- সেটিও আমলে নিতে হবে। কারণ, দেখা যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ঠিকই। সেই সাথে থেমে নেই আয় বৈষম্য। মাথাপিছু আয় পৌনে দুই হাজার ডলার ছাড়ালেও, এখনো মোট জনসংখ্যার নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের গড় আয় ১ হাজার ডলারের নিচে। এই পরিসংখ্যান নিশ্চই অর্থনীতির সুষম স্বাস্থ্যের প্রতিফলন নয়। এই বিষয়গুলো অর্থমন্ত্রীর একেবারেই জানা। সমাধানের উপায়ও নিশ্চই তার কাছে রয়েছে।
স্বল্পমেয়াদি এই সমস্যা বা চাহিদাগুলোর সমাধান সাধারণ মানুষের মনেও ইতিবাচক বার্তা দেবে। যারা এদেশের উন্নয়নের জন্য দিন রাত কাজ করেন। কিন্তু, একই গতিতে চালিয়ে নিতে, লম্বা পরিকল্পনার নানা বিষয়ও।
লেখক- ইকবাল আহসান- সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল২৪
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।