নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার দিন ১৬ জুলাই
প্রকাশিত : ১০:১১, ১৬ জুলাই ২০২০
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রগতি ও উন্নয়নের যে পথটি আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি, অতীতে তা কখনই মসৃণ ছিল না। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে আসতে হয়েছে। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। আজকের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে অনেক কালো অধ্যায় পার হয়ে আসতে হয়েছে। বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের অর্জন আজকের এই বাংলাদেশ। এর নেপথ্যে যে মহান মানুষটির অবদান অবিস্মরণীয়, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র তিনি বুনে দিয়েছেলেন তাদের হৃদয়ের কন্দরে। রক্ত-সাগর পাড়ি দিয়ে মুক্তির বন্দরে তাই ভিড়েছিল স্বাধীনতার নৌকা। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন ভূখন্ড উপহার দিতে পেরেছিলেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সেই দেশটি আজ উন্নয়নের মডেল। কিন্তু বাধা তো শেষ হয়নি। এখনও পাড়ি দিতে হচ্ছে বন্ধুর পথ, এখনও বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে চলতে হচ্ছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, শেখ হাসিনার পায়ে পায়ে পাথর। সেই পাথর সরিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে এক সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে গেলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গভীর এক ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশ। সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরে উন্নয়নের নতুন পথে শনৈ শনৈ এগিয়ে নিয়ে চলেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা, তার অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটিয়ে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই কিছু কিছু ঘটনা যেন বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। যদি বলা হয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। যেমন ধরা যাক বঙ্গবন্ধুর কথা। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুকে কোনোদিন মুছে ফেলা যাবে না। অথচ তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার কত চেষ্টাই না হয়েছে! বঙ্গবন্ধুকে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতিতে অভিষেকও তো তাঁর জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। অতীতে মসৃণ ছিল না তাঁর রাজনৈতিক চলার পথটি, এখনও নয়।
দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরও ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করেছে ঘাতক। একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। একসময় রাজনীতি থেকে তাকে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টাও করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় তাকে। চার বছরের জোট অপশাসনের পর সে ছিল এক ‘চেপে বসা’ শাসনকাল। তত্ত্বাবধায়ক নামের নতুন এক দীর্ঘমেয়াদি শাসনব্যবস্থা ওয়ান-ইলেভেন নামের পট পরিবর্তনের পর সেই ‘চেপে বসা’ গোষ্ঠী সরকার পরিচালনায় আসে। এই সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়।
বরাবরই আমরা দেখে এসেছি, ‘চেপে বসা’ শাসকদের চরিত্র এ রকমই হয়। সেখানে মানুষ উপেক্ষিত থাকে। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা ‘চেপে বসা’ শাসকদের পছন্দ নয়। মানুষ নয়, অন্তরালের অন্য কিছু যখন ক্ষমতার নিয়ামক হয়, তখন জনমত যে উপেক্ষিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব তখন অপরাধ হয়ে দেখা দেয়। এমনটিই ঘটেছিল ২০০৭ সালে। ‘চেপে বসা’ শাসকগোষ্ঠী তখন মানুষের কণ্ঠরোধ করেছে। সবকিছুই তখন চলেছে শর্তের বেড়াজালে। অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার নামে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সে সময়। মানুষের অধিকার আদায়ের অগ্রনেত্রী শেখ হাসিনা যখন মানুষের হারানো অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার, তখনই রুদ্ধ করা হলো তাকে। সে এক দুঃসহ দিন। বাংলাদেশে তখন চলছে ‘তত্ত¡াবধায়ক’ নামে ‘চেপে বসা’ অপশক্তির দুঃশাসন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশকে সত্যিকার অর্থেই দুর্যোগের মেঘ আচ্ছন্ন করেছিল তখন। গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে ‘চেপে বসা’ শাসকগোষ্ঠী তখন রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননে ব্যস্ত। রাজনীতি তখন যেন গর্হিত অপরাধ। রাজনীতিক পরিচয়টিও যেন হানিকর। শাসনের নামে ত্রাসের রাজত্ব। ‘চেপে বসা’ তত্ত্বাবধায়ক নামের অপব্যবস্থায় জনজীবনে নাভিশ্বাস।
সেই সময়, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সূর্য ওঠার আগে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়, টেলিভিশনের পর্দায় তার লাইভ সম্প্রচারও দেখেছে দেশের মানুষ। ঢাকায় তখন রাত পৌনে ৪টা। যৌথবাহিনী ঘিরে ফেলল সুধা সদন জননেত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় তখন মধ্যরাত। সেলফোনে খবরটা জানালেন বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রিয়ায় বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ও অনুসারীদের ফোন করে ঘুম থেকে জাগিয়ে নেত্রীর গ্রেফতারের খবর দেই এবং সকাল ৮টায় অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় স্টার্ড পার্কে শেখ হাসিনার গ্রেফতারের প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ আহবান করি আমরা। ফোন করি লন্ডনে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে। ফোনের ওপারে তার কণ্ঠেও হতাশা। আমি আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাই তাকে। তিনি আমাদের উৎসাহ দেন। তাৎক্ষণিকভাবে ‘শেখ হাসিনা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের পরামর্শ দেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। পরদিন অস্ট্রিয়া সময় সকাল ৮টায় বিপুলসংখ্যক বাঙালি নারী-পুরুষ উপস্থিত হন বিক্ষোভ সমাবেশে। অস্ট্রিয়া প্রবাসী সর্বস্তরের বাঙালিদের নিয়ে ‘শেখ হাসিনা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। নেত্রী গ্রেফতারের পর থেকে তার মুক্তির দাবিতে প্রতি মাসে ভিয়েনায় চারটি করে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়ে আসছিল। আমরা গণস্বাক্ষর, অস্ট্রিয়ান পার্লামেন্টের সামনে মানববন্ধন, গণঅনশন কর্মসূচিও পালন করেছি।
শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে মুক্ত করতে তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছোট বোন শেখ রেহানা টেলিফোনে সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিভিন্ন নির্দেশনা ও উপদেশ দিয়েছেন। তারা ছিলেন প্রত্যয়দৃপ্ত। তারা জানতেন সব ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে বাংলার মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত শেখ হাসিনা একদিন ঠিকই ফিরে আসবেন তার বিশ্বাসের মানুষের কাছে। ২০০৮ সালের জুন মাসে তিনি মুক্তি পেলেন। আর, একই বছর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে তো পাল্টে গেল পুরো চালচিত্র।
আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রের যে বিষয়টি সবার আগে দৃষ্টি কাড়ে তা হচ্ছে তার গভীর প্রত্যয়। দেশ ও মানুষের কল্যাণে তিনি সবসময় নিবেদিত। গভীর সংকটেও তিনি জনগণের কল্যাণ চিন্তা করেন। তার সেই চিন্তার প্রতিফলন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব অর্জনে। আর এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাঙালির সবচেয়ে বড় পাওয়া। ঘৃণ্য শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার আদর্শ মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সুযোগ্য কন্যা, সেই আদর্শের পতাকা হাতে সামনে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিয়েছেন জীবনের ঝুঁকি। জনগণকে আস্থায় নিয়ে রাজনৈতিক কল্যাণের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার, তা থেকে তিনি একদিনের জন্যও বিচ্যুত হননি। দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রায় কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বাবার মতোই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে নিঃসঙ্গ পরবাস। স্বামী-সন্তান নিয়েও গভীর বেদনার দিন পার করতে হয়েছে তাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়েও স্বদেশে ফিরতে পারেননি তিনি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের দুঃখী মানুষের নেতা; তার পরিবারকে সমূলে উৎপাটনের ষড়যন্ত্র আজকের নয়, দীর্ঘ কয়েক যুগ থেকেই চলছে। সাহসী রাজনীতির পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাসকে মুছে ফেলে দেওয়ার কী কুৎসিত-নির্মম ও ভয়াবহ চক্রান্তই না করেছিল প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাজনৈতিক নিষ্ঠুর প্রতিহিংসাপরায়ণ সেই চক্রান্তের জাল ক্রমেই বিছিয়েছে গোপনে! শুধু কি তাই, হীন চক্রান্তকারীরা চেষ্টা করেছে সংকীর্ণ রাজনীতির হীনম্মন্যতার ছদ্মাবরণে তার ভাবমূর্তিকে নস্যাৎ করতে। সেই চক্রান্ত কি আজও চলছে? আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির বিরুদ্ধে কি নিরন্তর ষড়যন্ত্র করছে কোনো গণবিরোধী চক্র? দেশটিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে এখনও প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তৎপর। ঘাপটি মেরে আছে রাজনৈতিক অপশক্তিও। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সম্মিলিত প্রয়াস।
জনগণই বাংলাদেশের প্রাণশক্তি। সেই জনগণকে রক্ষা ও সুসংহত করেই রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বও জনগণের। সকালের আলো ঢেকে দেওয়া কালো দিন ১৬ জুলাই। আজ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন মন্ত্রে নতুন করে উজ্জীবিত হই আমরা। জনগণের জয় হোক।
লেখকঃ সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি, মানবাধিকার কর্মী
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।