ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

টেলিভিশনে সুবীর নন্দীর শেষ সাক্ষাৎকার

নায়ক জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার খুব মিল ছিল [ভিডিও]

প্রকাশিত : ১৫:১২, ৯ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৫:৪০, ৯ মে ২০১৯

আশি এবং নব্বই দশকে ঢাকার চলচ্চিত্রে তার গান তাকে দারুণ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীত জীবনে রেডিও, টিভি এবং চলচ্চিত্রে আড়াই হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন সুবীর নন্দী।

দেশ বরেণ্য এই জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মারা যাওয়ার আগে তিনি একুশে টিভির এক সাক্ষাৎকারে নিজের অজানা বিভিন্ন বিষয় দর্শকদের মাঝে তুলে ধরেছেন। একুশে টিভির পাঠকদের জন্য তার সাক্ষাৎকারের একটি অংশ তুলে ধরা হলো-

এক প্রশ্নের জবাবে সুবীর নন্দী বলেন, একুশে পদক পাওয়ার পর মনে হয়েছিল একুশের সঙ্গে আমার জাতির সম্পর্ক। এটি আমাকে বাংলাদেশের সরকার দিয়েছে। যে কোনো পুরষ্কার মনে হয় আর একটু দেরিতে পেলে ভালো হতো। আমি তাড়াতাড়ি পেয়েছি।

‘পুরস্কার পাওয়ার জন্য লবিং করার চেষ্টা বা মরিয়া হওয়াকে আমি বিশ্বাস করি না। সাদামাটাভাবে আমি মনে করি যে, আমি আমার কাজ করে যাব। একজন শিল্পী কখনও পুরষ্কার পাওয়ার জন্য কাজ করেন না। আমার কাজ হলো গান করা মানুষকে আনন্দ দেওয়া। ভালো কাজ মানুষের কাছে যে কাউকে আইডল করে তোলে। আর পুরস্কার তো একটা প্রক্রিয়া মাত্র। আমি এমনভাবেই নেই। তবে এটা সত্য যে একুশে পুরস্কার পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার।’

‘১৯৪৩ সালে ৩য় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি গান করতাম। সে সময় আমাদের বাড়িতে একটা প্রচলন ছিল, আমরা সন্ধ্যা বেলায় প্রার্থনা করতাম। এটা আমাদের বাড়িতে একদম বাধ্যতামূলক ছিল। মা এ বিষয়গুলো দেখতেন। আমরা ভাইবোনরা সবাই ঐ প্রার্থনায় অংশ নিতাম। তারপরে আমার বাবার অনেক রেকর্ড ছিল। তিনি ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করতেন আসার সময় অনেক রেকর্ড নিয়ে আসতেন। সে সময় থেকে বড় বড় শিল্পীদের গান শুনতাম। তারপরে ভাবতাম যে, আমি যদি গান গাইতে পারতাম, পুরস্কার পেতে পারতাম।’

সুবীর নন্দী বলেন, শিশু বয়সে ওই বিষয়টা একটা জেদ ছিল যে, কি করে গান করা যায়। আমার বড় ভাইও খুব গান করতে সে স্থান থেকেই গান করতে শুরু করলাম। পড়ালেখার পাশাপাশি গান গাইতাম। ১৯৬৭ সালে আমি ও আমার বড় ভাই তপন নন্দী এনডিসির আর্টিস্ট হই। তারপর স্বাধীনতার পরে ঢাকা রেডিওতে গান করি। তখন স্টুডিও রেকর্ড বলতাম আমরা। বাংলা গান, সিনেমার গান কিছু কিছু করা হতো। সেখান থেকে জাতীয় পর্যায়ের শুরু। আমার মনে আছে আমার প্রথম গানটি করেছিলেন ওস্তাদ মীর কাসেম খান। সে এক বিশাল কাহিনী বসতে বসতে তারপর চান্স পেলাম। সেই সময় চান্স পাওয়া খুবই কষ্টের ছিল।

তিনি বলেন, আমি সিলেট থেকে আসতাম মোজাক্কের ভাই রেডিওর প্রোগ্রাম প্রডিউসার ছিলেন। এক বার, দুই বার ও তিন বার আসার পরই আমি মীর কাসেম সাহেবের চোখে পড়ি। বললেন, ‘এই বাচ্চাটি কে? প্রায় সময় দেখি বসে থাকে বসে থাকে। তখন মোজ্জাক্কের বললেন যে, ‘ও ভালো গান গায় ওকে টাইম দিতে পারছি না নিচ্ছিও না।’ পরে কাসেম সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কাছে কোনো গান আছে কিনা? তখন দুপুর আড়াইটা বাজে। মোজাক্কের ভাই আবার গান মুখস্ত রাখতে পারতেন। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখন সুর তুলতে পারবে। আমি হ্যাঁ বললাম। স্টুডিওতে গেলাম এবং প্রথম সুর উঠালাম।

’কিছু কিছু গান আছে কিছু দিনের জন্য ভালো লাগে আবার কিছু দিনের পর ভালো লাগে। আমি বলব যে, একটা গান আসে আমার ঐ সময় কার গাওয়া, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’। গানটির গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু এবং সুরকার শেখ সাদি খানের সুর। আমি ও নজরুল ইসলাম বন্ধু ছিলাম। ‘

’একুশে পদক পাওয়া নিয়ে তিনি আরও বলেন, অনেক সময় আমরা সাধারণত দেখি মরণোত্তর পুরস্কার পায়। তবে জীবিত অবস্থায় পুরস্কার পাওয়া উটিত। আমার গলার সঙ্গে সিনেমার নায়কের ‘লিপ’ মিলত নায়ক জাফর ইকবাল সাহেবের সঙ্গে। তারপর ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে মোটামুটি মিলে যেত। নায়ক জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার খুব মিল ছিল।‘

 সুবীর নন্দী বলেন, আমাদের দেশে এখন গানের সঙ্গে জড়িতদের এক সঙ্গে দেখা যায় না। একেকজন একেক রকমের কাজ করেন। সেই বাদ্যযন্ত্র তো আর নেই। এক কি বোর্ডের মধ্যেই এখন সব। আগে যারা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন তাদেরকে এখন ডাকা হয় না অনুষ্ঠানে। ডাকা হয় হয়ত ৫ মিনিট বা ১০ মিনিট, এই শেষ। গানের কথা বা গানের সুর যদি মানুষের মন স্পর্শ না করে তাহলে তা কতটুকু গান হয়। গান শোনার পরই যদি শ্রোতারা ভুলে যান।

তিনি বলেন, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি’, ‘তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়’, এসব গান এখন তেমন একটা হয় না। কিছু কিছু হলেও সেই গানগুলো আর প্রচার হয় না। শ্রোতাদের স্বাদ ও শিল্পীদের অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে বিষয়টি এমন হয়েছে। আমি যদি মনে করি, এই গানটি অনেক সুন্দর আমার ভালো লাগে। তাহলে তো আমাকে শুনাতে হবে তো। আমরা শিল্পীরাই শ্রোতাদেরকে কিছু অংশে নষ্ট করেছি। তবে ভালো গানের কোনো সংজ্ঞা নেই। সবাই তো এক ধরনের গান শুনতে চায় না। শ্রোতাদেরও পছন্দ আছে। এখন গান শুনাতে শিল্পীরা বড় বড় শহরের বাইরে যেতে চান না। আর আমরা সে সময়ে একদম অজপাড়া গায়েও গিয়েছি।

’১৯৮১ সালে আমি গানের অ্যালবামের জন্য গান গাই। তবে আমার জনপ্রিয়তা রেডিও থেকে আসে। ৩/৪ দিন অনুশীলন করে তারপর রেকর্ডিং হতো। তবে অর্থনৈতিক বিষয়টি কখনও গুরুত্ব দেইনি। কারণ তা শিল্পী দেন না। আমি ব্যাংকে চাকরি করেছি কারণ স্বাধীনতার পর সব পরিবারেরই ভঙ্গুর দশা ছিল। ছোট ভাই বোনদের দায়িত্ব নিতে হয়েছি। তবে ব্যাংকে চাকরি করে আমার জন্য বেশ ভালোই হয়েছিল। কেননা একটা ডিসিপ্লিন লাইফ ছিল। সকালে উঠতে হবে, এই করতে হবে সেই করতে হবে। ডিসিপ্লিন লাইফ সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান শিল্পীরা অনেকেই যা করেন তাতে ক্ষতি হয়। সাধারণত রাতের বিশ্রামই সুষ্ঠু বিশ্রাম। আর রাতে মানে গভীর রাতে গানের অনুশীলনে ভোকাল কটে বেশ প্রেসার পড়ে।’

সুবীর নন্দী বলেন, সারাদিন আপনি এদিক ওদিক দৌঁড়ে এসে রাতে গান গাইলে তো আপনার ভোকাল কট ক্লান্ত থাকবেই। সেই সময়ে আপনি অনুশীলনে বসলে ভালো হবে না। এমন করলে প্রথম প্রথম সহনীয় হয় বয়সের কারণে কিন্তু তা ভালো নয়। তবে কাজের জন্য যেমন রেকর্ডিং বা সিনেমার শুটিং হলে ভিন্ন বিষয় তবে অনুশীলন নয়। সব সময়ই যে করতে হবে তা নয়। কিছু বিষয় আছে যা শুনেই হয়। সোনাকে যত ঘষবেন তত চকচকা হবে। হাদি ভাই আমাদের অনেক সিনিয়র, তিনি যখন মাইক্রোফোন হাতে নিতে তখন গলা গমগম করত। বর্তমান অনেক গানই আর মনকে স্পর্শ করে না। যেমন, গানে তুই এই সব চলে এসেছে। যা গানের জন্য ভালো নয়। আর যাই বলেন না কেন আমি কোন কাজ করলে তার একটা মান থাকতে হবে।

তিনি বলেন, আমি এমন কোনো গান করতে পারি না যে গান বাংলাদেশের পুরো গানকেই নষ্ট করে দিবে। অনেক গান আছে যে গানগুলো শুনেও না শুনে থাকি। হয়ত সময়ের দাবি তবে তা তো সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। যে গান সমাজের ক্ষতি হয় সে গান নাইবা গাইলাম।

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি